Wednesday, November 21, 2018

মুইঠ অনা

আজ অঘ্রাহায়ন পয়লা। চাষীর ঘরে মুঠ আনা আজ এক মজার অনুষ্ঠান। ভোরবেলায় চাষী স্নান করে নতুন কাপড়-চোপড় পরে কাস্তে নিয়ে মাঠে হাজির। জমির ঈশাণকোনে আড়াই মুঠি ধান আড়াই প্যাঁচে কেটে নতুন/ কাচা কাপড় জড়িয়ে মাথায় নিয়ে চুপটি করে সোজা বাড়ি। খামারে পালইয়ের সামনে রেখে দিয়ে শুরু হয় পুজো-অর্চনা অন্ন দেবী/ টুসু মায়ের আরাধনা।


বস্তুতঃ একটা সময় এই মুঠ আনার মধ্য দিয়েই গ্রাম বাঙলায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতো ধান কাটা। নতুন ফসল ওঠার মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ দিয়েই শুরু হতো বছর গণনা। কালের বিবর্তনে নিয়ম বদলেছে, তবে প্রথা কিছু রয়ে গেছে।
আদিবাসী কুড়মি/ চাষীদের কাছে ধান শুধু আহার্যবস্তুই নয়; অর্থনীতি থেকে শুরু করে লোক উৎসব - কৃষ্টি তথা লোকসংস্কৃতির বারো আনাই ধান কেন্দ্রিক। আষাঢ় থেকে পৌষমাস - আমনধানচর্যার যেন মহাকাব্যিক বিস্তৃতি।
 মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে। শুরু হয়েছে ধান কাটার মরশুম।।মাঠে ঘাটে সব জাইগাতে মানুষের ঢল, নাস্তাপানি খাওয়া-দাওয়া সবই মাঠে-ঘাটে। দূর-দূরান্তের  লোকজন, জন-মজুর খাটতে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের  বর্দ্ধমান (বর্তমান পূর্ব বর্দ্ধমান)বাঁকুড়া,মেদিনীপুর,পুরুলিয়া জেলার গাঁ-গঞ্জে। এখানকার লোকেরা বলে মুনিশ। পরিযায়ী পাখির মতো দুদ্দার ভিড় করে বছরে দুবার। ধান লাগানো আর এই ধান কাটায়।। ধান কাটা, গোঁচ বাঁধা - বিঁড়ে সাজানোয় এ অঞ্চলের মুনিশরা এক একজন সহজ শিল্পী। খাটো দিনের বেলা। দুপুরের আজান শুনেই কর্মবিরতি। বেলা ঢলতেই দিগন্তে কুয়াশার সঙ্গে আঁধার নামে গুটি গুটি পায়ে। জনহীন প্রান্তরে পড়ে থাকে মাঠের সোনালি শস্য - ধান!
গ্রাম বাঙলার মানুষের কাছে ধান শুধু আহার্য বস্তু নয়; সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুন। জুতো পায়ে বা আকাছা হয়ে ধানে হাত-পা ঠেকানো একেবারেই বারণ। কিম্বা জোরে শব্দ করলে গেরস্থরা রেগে টঙ। কারণ লক্ষ্মী বড়ো পয়মন্ত শান্ত দেবী। বেশী গোলমাল হলেই তিনি টুকুস করে কেটে পড়েন। আর সেই স্থান দখল করবেন রুক্ষকেশী অলক্ষ্মী!
 তাছাড়া ধান-চালের সঙ্গে আদিবাসী কুড়মি জনজাতির সম্পর্ক কী আজকের?
 সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন থেকে আমাদের  প্রত্ন-উৎখননে সর্বনিম্ন স্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে ধানচাষের প্রত্ন নিদর্শন। তারপর যতদিন গেছে ধানের সঙ্গে চাষীদের মন প্রাণ গেছে জড়িয়ে। ধান শুধু চাষিকে ধনবানই করেনি; দিয়েছে সম্মান। চাষীর কাছে ধানী জমি জোয়ান ব্যাটার সমান। আবার অর্থ থেকে পরমার্থের প্রতীক ধান। মানুষের বিয়ে-বা মাঙ্গলিক কর্মে দান-ধ্যানের সঙ্গে দুব্ব্যো ঘাস সহ ধান হয়ে উঠেছে আশীর্বাদের প্রধান উপকরণ। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থান থেকে প্রাপ্ত মৌর্য আমলের এক শিলালিপি। এতে খোদিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা ধান্যভান্ডারের কথা।
লক্ষণ সেনের আনুলিয়া, তর্পণদিঘি, গোবিন্দপুর, শক্তিপুর তাম্রশাসনগুলির মঙ্গলাচারণ শ্লোকে গাঁথা ধান্যবন্দনার কথিকা। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। বোঝা যায় প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল ধান। আজও তার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তাই ধানী জমি নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেললে তার পরিণাম যে ভয়ংকর । ধান কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি আর যাবতীয় লোকউৎসব আমনকে কেন্দ্র করেই। রামাইপন্ডিতের শূণ্যপুরাণ নাকি চর্যাপদের সমসাময়িক রচনা। এতে হরেক রকম আমনধানের কথা আছে যেমন কনকচূড়, কাঙুদ, কলমা, কসুমশালী, খিরখম্বা, গোতমপলাল, ঝিঙাশাল, সীতাশালী, লাউশালী, মুক্তাহার, মৌকলস, গৃহিনীপাগল, ইত্যাদি।  আগে গোবিন্দভোগ ধানের মাঠে ভুর ভুর করে সুগন্ধ ছড়াতো হেমন্তের বাতাস।
 তবে চাষীরা আর আপন মনে  গানে ভরিয়ে দেয়না বর্ষণসিক্ত আষাঢ়ের মাঠ-ঘাট...
নাগর কোথায় রইল্যা রে...
জল লেগেছে তোমার বাকুড়িতে।।
শ্রাবণ মাসের রিমিঝিমি বরিষণে ধান্যসুন্দরীরা গায়ে গতরে বেড়ে ওঠে। আসে তাদের নবযৌবন। ধান্যবতীরা হয়ে ওঠে গর্ভবতী। ধীরে ধীরে বিয়েন ছাড়ে। থোড় আসে। আর জমে ওঠে দুধ। আশ্বিনসংক্রান্তি হলো ধানের পূর্ণ প্রসব কাল। তারপরই পেকে ওঠার সময়। ধানিজমি যেন কৃষিলক্ষ্মীর আদিগন্ত সবুজ শাড়ি। লেগেছে তাতে সোনার পরশ। ধানের বনে হিমেল হাওয়া আর সোনা রোদের মাখামাখি, মাতামাতি। পরম তৃপ্তিতে পেকে উঠেছে আগুন রঙা ধান 

অঘ্রান মাস পড়তে না পড়তে মাঠের রঙ বদলাতে শুরু করে। আগুন রঙা ধান ক্রমশ পাকা সোনায় পরিণত। উদ্ধত ঋজু ধান এবার সকল অহংকার লুপ্ত করে ফলভারে নত। শুরু হলো ধান কাটা। এবার লঘু অর্থাৎ নতুন ধান্যে হবে নবান্ন গ্রাম বাঙলার ভবনে ভবনে...
****
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পোস্ট - সঞ্জয় মাহাত( হিন্দ্য়ার)