Saturday, December 29, 2018

টুসু পরব: ছোটনাগপুরের শ্রেষ্ঠ উৎসব!!


লিখেছেন -মৃন্ময় বঁসরিয়ার

শীত মানেই পার্বণ, শীত  মানে পৌষ মেলা, শীত মানেই জমিয়ে খাওয়া দাওয়া। শীত মানেই  ভ্রমণ, কুহুভাত, ডিবুভাত, বনভোজন, পিকনিক। শীতে গঙ্গাসাগর মেলা, জয়দেবের মেলা অপামর ভারতবাসীর আকর্ষণের অন্যতম কারন। বাঙালিদের নবান্ন উৎসব এই পৌষেই, মকর সংক্রান্তিতে মকর স্নান, বাড়িতে বাড়িতে লক্ষীর আরাধনা, আলপনা, পিঠে-পার্বণ-  সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কেউ মনে রাখেনা এই “পৌষ পরবের স্রষ্টা” আদিবাসী সমাজকে। 
   
ভারতবর্ষের সবচেয়ে অনুন্নত, জঙ্গলময়, পর্বতবেষ্টিত ছোটনাগপুর মালভূমি । সরস গাঙ্গেয় সমতল থেকে পৃথক ভূপ্রকৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক সামাজিক বিশিষ্টতা এই অঞ্চলকে যে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে সেই স্বাতন্ত্র্যই তাকে আজও আধো-চেনা করে রেখেছে। কৃপণ প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ ঊষরতা, শীততাপের তীব্রতা - এসবের সঙ্গে অনবচ্ছিন্ন সংগ্রামে নিরত এখানকার প্রধানত কৃষিনির্ভর কুড়মি আদিবাসী জনজীবন।
   
 সংগ্রামে যেমন ধরা দেয় লোকজীবনের দুর্দম প্রাণস্পন্দন, লোক-উত্সবে তেমনই ধরা দেয় তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বাস। নিরন্তর সংগ্রাম আর বঞ্চনার ব্যথা শাল, মহুল, পলাশ, কুসুমের দেশের মানুষের প্রাণের সেই উচ্ছ্বাস দমন করতে পারেনি। টুসু, করম, বাঁদনা, ইঁদ, জিতা, চড়ক, পরব বা শিকার পরব - নানা উত্সব, পরবের আনন্দ দিয়ে দৈনন্দিন দুঃখগুলো মুছে ফেলতে জানে এখানকার মানুষ। 

    গাঙ্গেয় বঙ্গের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো যে উদ্বেলতা সৃষ্টি করে, সমগ্র ছোটনাগপুরে তা অনেকাংশে নিস্তেজ। যে উৎসব এখানে আরও বেশি গুরুত্ব পায়, যে উৎসবে এই ভূখণ্ডের গভীর, বর্ণময় স্বতোত্সার ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি তা হল টুসু পরব। 
    এই উত্সব পৌষালি ফসলের উৎসব, নানা লোক-উৎসবের মতোই কৃষিকেন্দ্রিক, বিদ্বজ্জনের মতে, ফার্টিলিটি রিচুয়াল অর্থাত উর্বরাশক্তির উপাসনা। এই পুজোর পুরোহিত নেই, নেই পূজন-মন্ত্র। এই পুজো  মূলত মেয়েরাই করে, পূজন-মন্ত্র হল গান। গানের ভাষা শহুরে মানুষের সুমার্জিত, সুসংস্কৃত, কৃত্রিম ভাষা নয়। এ ভাষা সহজ, সরল লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুখ-দুঃখ, বাৎসল্যরস, প্রেম-বিরহ, ঈর্ষা-অভি ফুটে ওঠে চাকচিক্যহীন ভাষায়। পৌষ মাস শিশির-সিক্ত নতুন ফসলের মাস। কৃষকের সেই আনন্দ উচ্ছলিত হয় টুসু উৎসবে। টুসু গাঙ্গেয় সমভূমির স্বর্গবাসিনী  শ্রেণীর নন, নেহাতই ঘরের মেয়ে, গিরিরাজকন্যা মহামায়ের কাছাকাছি। অসুরদলনী, সিংহবাহিনী, দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা থেকে শত  মাইল দূরে।
এই সময়  সমগ্র ছোটনাগপুর জুড়ে  আকাশে বাতাসে টুসুগানের মেঠো সুর ধ্বনিত হয়, এই লোকগানের সুরে মুগ্ধ হওয়ার সেরা সময় তো এটাই। কিন্তু এর বেশি পরিচিতি নেই, চাকচিক্য নেই, শহুরে হুল্লোড় নেই- তবু  মানুষগুলোর প্রানের উৎসব টুসু, এই উৎসব মাটির উৎসব।  নিজগুণে এক ঘরের মেয়ে -সমগ্র নারীকুলর প্রতীক হয়ে ওঠে, টুসু  মানব ও প্রকৃতির এক মিলিত বিগ্রহ। মুলতঃ  টুসু আসলে কৃষিভিত্তিক আঞ্চলিক পার্বণ  । 
 মূল আকর্ষণ এক মাস ধরে গাওয়া টুসু গান, সন্ধ্যা নামলেই সমবেত কন্ঠে গায় পূজারিণীরা। এরপর আসে পৌষ সংক্রান্তি। পৌষের শীতল রাতে, পাড়ার মেয়ে-বউরা সুরের মূর্চ্ছনায় জাগিয়ে রাখে রুখামাটির গ্রামগুলোকে। বক্স, লাউড স্পিকারে বাজতে থাকে এসব গান। টুসু গানের কথায় ফুটে ওঠে ছোটনাগপুরের সামাজিক চিত্র, সুখ-দুখের কাহিনী। টুসু জাগরণের রাত বাঁউড়ি নামে পরিচিত।
একটা বিখ্যাত টুসু গানের কথা শুনলেই বোঝা যায় টুসু তাদের ঘরে মেয়ে।
-"চল টুসু চল খেলতে যাবো, রানীগঞ্জের বটতলায় ।।
খেলতে খেলতে দেখে আসবো কয়লা খাদের জল তুলা ।
হলুদ বনের টুসু তুমি হলুদ কেন মাখো না ।। 
শাশুরি-ননদির ঘরে হলুদ মাখা সাজ না ”

    ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পশ্চিম রাঢ়ের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ছাড়াও বিহারের ধানবাদ, সিংভূম  এই উত্সবের ব্যাপ্তি হলেও উৎসবের প্রাণকেন্দ্র হল পুরুলিয়া। তুষু, টুসু, তোষলা, তোষালি, মকর ইত্যাদি নানা নামে এর পরিচয়। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে উৎসবের উদ্বোধন এবং এক মাস পরে পৌষ সংক্রান্তিতে তার সমাপন। 
   স্থাপন,পালন, জাগরণ ও বিসর্জন। উত্সবের সমগ্র বিস্তারটির চারটি পর্ব। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে বাড়ির আঙিনা বা অন্য কোনও উপযুক্ত স্থানে আলপনা এঁকে সেখানে টুসুকে স্থাপন করা হয়। পৌষ মাসের প্রতিদিন সেখানে প্রদীপ দেওয়া হয়। টুসুর ঘুম ভাঙিয়ে চিঁড়ে, মুড়ি, গুড়, মণ্ডা ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়।  অনেক রাত ধরে  চলে মেয়ে-বউদের গান। তার পরদিন সন্ধ্যা  টুসুকে ঘুম পাড়ানো হয়। এটা হল পালন পর্ব। পৌষ-সংক্রান্তির আগের রাত হল জাগরণের রাত।  রাত ধরে গানে গানে হয় পুজোর অনুষ্ঠান। পৌষ-সংক্রান্তির দিন টুসুর বিসর্জন। এবং পরের দিন তারা নতুন কৃষিবর্ষকে বরন করে। 

    পুজোর উপচারও সরল। পোড়া মাটির সরার চারপাশে জ্বলে মাটির প্রদীপ। পিটুলি গোলা দিয়ে সরার গায়ে আঁকা হয় নানা চিত্র। সরার ভেতরে থাকে নতুন ধান, তুষ মেশানো নাড়ু, গোবরের দলা।সরা সাজানো হয় ফুল, ফুলের মালা, কড়ি, কুঁচ, সরষে ইত্যাদি দিয়ে। সরার বদলে কেউ কেউ ঘটও ব্যবহার করে। কেউ আবার সরার ওপরে ঘট বসায়। এই-ই হল টুসু। আজকাল মূর্তি গড়েও পুজো করছে অনেকে যা কুড়মালী সংস্কৃতি বিরুদ্ধ। ছোট হলুদ রঙের মূর্তি, পরনে লাল বাঃ নীল শাড়ি। মাথার পেছনে জ্যোতির্বলয়। বিসর্জনের দিন চোড়লের ভেতরে সরা বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে বা বাঁধে।

    চোড়ল বা চৌড়োল বা চৌডোল অর্থাত চতুর্দোলা টুসু পুজোর এক অপরিহার্য অঙ্গ। বাঁশের বাখারি বা চেলা কাঠ আর গাছের সরু ডাল দিয়ে তৈরি খাঁচার ওপর রঙিন কাগজ মুড়ে নানা নকশা আর কাগজের ফুলে-মালায় সাজিয়ে তৈরি করা হয় এক চমত্কার চারপায়া রথ।

    পৌষ-সংক্রান্তির কয়েক দিন আগের থেকেই চোড়ল বিক্রি শুরু হয়। টুসু পুজোর সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অংশ বিসর্জনের দিন সকালে চোড়ল নিয়ে শোভাযাত্রা। টাঁড়, ডহি-ডুংরি পেরিয়ে, পায়ের-পাতা-ডোবা ধুলো বাতাসে উড়িয়ে, উঁচু-নিচু আলের পথ ভেঙে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ শাড়ি-জামা পরা মেয়েদের চোড়ল মাথায় নিয়ে গান গাইতে গাইতে নদী বা বাঁধের দিকে শোভাযাত্রা এক অনুপম চিত্তহারী দৃশ্য রচনা করে। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের দেখা হলে গান আরও উচ্চগ্রামে ওঠে এবং গানের লড়াই শুরু হয়ে যায়। দুই টুসুতে সই পাতানো হয়। আবার কার টুসু কত গুণের তাই নিয়ে বিবাদও হয়। সবই গানে গানে। বিসর্জন ঘাটের পথে শোভাযাত্রা করে গানে গানে এগিয়ে যায় সবাই। ঘরের মেয়েকে বিদায় জানানোর পালা, শোকবিহ্বল হয়ে পড়ে গ্রাম্য নারীরা। চোখের জলে আত্মমর্যাদার প্রতীক নয়ণের মনি টুসুকে বিদায় জানায় ভূম। গানের ভাষাতেই সেই দুঃখ ফুটে ওঠে।

" আমার টুসু ধনে 
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসুধন কে
পুজেছি যতনে। 
শাঁখা সাড়ি সিঁদুর দিলাম
আলতা দিলাম চরণে। 
মনে দুঃখু হয় বড়
ফিরে যাতে ভবনে 
দয়া কইরে আসবে আবার 
থাকে যেন মনে
ভুইলনা ভুইলনা টুসু
আসবে আমার সনে।"

    চোড়ল সহ টুসুর বিসর্জন এবং মকরস্নান হয় কাছাকাছি নদী বা বাঁধে। বাঁধ হল বড়ো জলাশয়। মেয়েরা  শুধুই চোড়ল বিসর্জন দেয়। সরা বা ঘট ঘরে রেখে দেওয়া হয় এক বছর। একে বলা হয় লক্ষ্মী বাঁধা। লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখা হয় ঘরে। চোড়ল বিসর্জন না দিয়ে  আবার সেটা ভেঙে টুকরোগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। কেউ কেউ আবার চোড়ল ঘরে ফিরিয়েও নিয়ে যায়।
    বিসর্জনের দিন নদীর পারে বা বাঁধের পাশে মেলা বসে। বাংলা-বিহার সী্তে সুবর্ণরেখার বাংলা-বিহার সী্তে সুবর্ণরেখার তীরে তুলিনে, কাঁসাই নদীর তীরে দেউলঘাটায়, শীলাবতী নদীর উত্সস্থলে, জয়দা, সতীঘাট প্রভৃতি জায়গায় বসে জমজমাট মেলা। 

     মকর/টুসু পরবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পুলি-পিঠে। নানা রকমের পিঠের মধ্যে সবচেয়ে রসনালোভন হল বাঁকা পিঠা/পুর পিঠা/ গড়গড়্যা পিঠা।  বিসর্জনের শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়া হবে পিঠে। পিঠে ছাড়াও সচ্ছল মানুষের খাদ্য-তালিকায় থাকবে খাসির মাংস আর খিচুড়ি। উৎসবের উত্স নিয়ে নানা মুনির নানা মত।  এসব ভাবনা বিদ্বৎকুলের জন্যই সংরক্ষিত থাক। এই মল্লভূমিতে পদার্পণের স্পর্ধা আমার নেই। 
    
    দেশের  ক্ষীণতোয়া অথচ প্রাণদ নদীর মতোই দীর্ঘকাল ধরে প্রবাহিত প্রাণোচ্ছ্বল এই উৎসবের ধারাটি আজ হয়তো কালের প্রভাবে কলুষমুক্ত থাকতে পারছে না। সংক্রমিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদ, দেবতায়ন, সভ্য সমাজের হিনমন্যতা, সচেতন হীনতা, অবহেলা, বারোয়ারি পুজোর উচ্ছৃঙ্খলতা, মাইকের উৎপাত, মত্ত কুৎসিত তাণ্ডবনৃত্য। তবু আশা করব, সব কিছু খুইয়েও আমরা যেমন শুভ সময়ের আশা করি, স্থানীয় লোকসংস্কৃতির এই সুন্দর ধারাটি সময়ের চোরা বালিতে তলিয়ে যাবে না। 

জীবনের সাথে প্রতিদিন লড়াই করতে থাকা মানুষগুলোর জীবনে টুসু পরব এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে রুখামাটির দেশেও বিশ্বায়ণের ছোঁয়া, একটু যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে টুসু পরব। বেঁচে থাকুক টুসু পরব। টুসু গানে পৌষের কনকনে সন্ধ্যাগুলো জমে উঠুক। শহুরে ফটোগ্রাফারদের আজকাল ভিড় জমে টুসু বিসর্জনের ঘাটগুলোয়। সবাইকে আমন্ত্রন করবো ঘুরে আসুন শুখামাটির দেশে, হারিয়ে যান লোকগানে, গ্রাম্য উৎসবে।

জহার 🙏

Thursday, December 27, 2018

ছোট নাগপুর মালভূমির চাষবাস সংক্রান্ত কিছু রীতিনীতি বা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা।



🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸🔸👉ছোটনাগপুর মালভূমির কুড়মি চাষি সম্প্রদায়ের চাষবাস সংক্রান্ত কিছু রীতিনীতি বা সংস্কার ও কুসংস্কার প্রচলিত আছে। বংশ পরম্পরায় সেই সংস্কারগুলি আমার পালন করে আসছি। কিন্তু এগুলির পিছনেও যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে তা আমরা নিজেও জানি না। তবে যারা শুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করবেন তারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। আমার জানা কিছু রীতিনীতি বা সংস্কার ও কুসংস্কারের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। এ আমার সম্পূর্নই নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অনেক ভুল ভ্রান্তি হতে পারে। যদি ভুল থাকে মন্তব্যে যুক্তিযুক্ত উত্তর দিলে অশেষ উপকৃত হবো। তাছাড়াও স্থান ভেদে আরো অনেক প্রচলিত রীতিনীতি আছে তাও উল্লেখ করতে পারেন যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি না পারলেও আরো অনেকের নজরে আসবে তারাও উত্তর দিতে পারেন। এতে আমিও ঋদ্ধ হবো। তাহলে শুরু করি বর্তমান সময় থেকেই।

#মুঠি_ধান_আনা_হয়_কেন?

=ধান কাটা শুরু করার আগেই মুঠি ধান এনে খামারে রাখা হয়।এতে পরীক্ষা করা যায় খামার ঠিক মতো জীবানু মুক্ত হয়েছে কি না। বার বার গোবর লেপে আমরা খামারকে জীবানু মুক্ত করি। তাতে উই পোকার আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবার ইঁদুরের উপদ্রবও জানা যায়।

#প্রথম ধান বা মুঠি ধান পুরুষেরাই কাটে কেন?

=আদিম কাল থেকে চাষবাস ছিল পুরুষ কেন্দ্রীক।ঘরের বাইরের কাজ পুরুষ করতো আর ঘরের কাজ মহিলারা করতো। চাষের শুরু থেকে অর্থাৎ বীজতলা (বিহন গাঢ়ি) তৈরী থেকে ডিনিমাঞ (ঠাকুর মাঞ) আনা পর্যন্ত, ধান ঝাড়া থেকে ঘরে ঢুকানো পর্যন্ত সমস্ত কাজ পুরুষেরাই করতো। পরে পরে মহিলারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি এখন চাষের কাজটা বেশী ভাগ মহিলা দ্বারাই হচ্ছে পুরুষেরা শুধু নিয়ম পালনটা করেছেন। আর একটা ধর্মীয় বিশ্বাসও কাজ করে এই কুসংস্কারটার পিছনে। অনেকেই অভিশাপ দিয়ে থাকে "আমার ধান যে কাটবে তার অমুক তমুক রোগ হবে"। তাই কাজের লোকেরা প্রথমে কাটতে চাই না।ঘরের কেউ শুরু করে দিলে সেই দোষ খন্ডণ হয়ে যায়। এই ধরনের কুসংস্কারও হতে পারে।

#ডিনিমাঞ বা ঠাকুর মাঞ রাখা হয় কেন?

=ডিনিমাঞ বা ঠাকুর মাঞ রাখার পিছনে দুটি যুক্তি আছে।
প্রথমত যখন প্রায় প্রায় সবারই ধান কাটা হয়ে যায় সেই সময় কোন একটা শুভদিন দেখে গ্রামের অধিকাংশ ঘরে ডিনিমাঞ আনে। এবং সেই সকল ঘরে  পিঠা করে মাংস রান্না করে। এতে সবার সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় থাকে। সবাই মিলে একটা উৎসবের দিন পালন করে।
দ্বিতীয়ত এই কারণটাকেই আমি আসল মনে করি। ধান ঝাড়াই করার সময় কুপি(মাটির ছোট মুখের পাত্র) রাখা হয় সেটাও এই কারণেই। 
বর্তমান যুগের মতো আগে চাষের কাজে এতটা সুবিধা ছিল না। এখন প্রতি বছর ধান বীজ কিনে বিহন করা হয়। আগে বিহনের ধান নিজেকেই রাখতে হতো। ছোট নাগপুর মালভূমির চাষবাস সম্পূর্নই বৃষ্টি নির্ভর। অতীত মানুষকে অনেক বার খরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরের বছর বৃষ্টিপাত হলো না। তখন জীব ধানকেই চাল করে খাওয়া হয়ে গেল। তার পরের বৎসরের জন্য ধান কারো কাছে নেই।তখন এই ডিনিমাঞ ও কুপির ধান থেকেই পুনরায় ধান চাষ করা যেত। অর্থাৎ ধান পুরোপুরি লুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা যেত।

#ধান ঝাড়ার সময় মাচার নিচে হাঁসুয়া (কাস্তে) রাখা হয় কেন?

=কথাটা বাবার মুখে শুনেছিলাম।ছোট নাগপুর মালভূমি এলাকাতেই কিছু নিম্ন জাতির মানুষ বাস করতো  তাদেরকে চিলহর আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ধান ঝাড়াই করে পরিস্কার  করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে
একটু সুযোগ পেলেই তারা  ঝুড়ি ভর্তি ধান নিয়ে  পালিয়ে যেত। তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে অস্ত্র রূপে কাস্তে রাখা হতো।

#ধান তুলার জন্য যে সকল ঝুড়ি ও কুলা ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে তুলসী পাতার জল ছিটা দিতে হয় কেন? 
এবং ধুনা জ্বালিয়ে ঝুড়িতে ধুনা ভর্তি করে ধানের উপরে ছড়ানো হয় কেন?

=প্রতিটা ভালোর সাথে কিছুটা খারাপ থাকে।ধানের সাথে আসে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু।
জেনে আশ্চর্য হতে হয় সেই আদিম যুগের মানুষেরা বিনা পরীক্ষাগারে আবিস্কার করে ছিল ধানের সাথে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু ঘরে চলে আসে। এবং তারা এটাও আবিস্কার করেছিল তুলসী পাতার জল ও ধুপের ধুঁয়াতে জীবাণু নাশক ক্ষমতা আছে। সেই কারণেই তুলসী পাতার জল ছিটা ও ধুনার ধুঁয়া দিতে হয়।

#ধান মাপার সময় কথা বলতে নেই কেন?

=ধান ঝাড়ার পর পরিস্কার করে ঝুড়িতে মেপে ঘরে ঢোকানো হয়।যখন ধান মাপা হয় তখন কথা না বলার কারণ চাষীরা বেশীর ভাগ অশিক্ষিত হলেও সম্পূর্ণ বৎসের খাদ্য সম্পরকে সচেতন ছিল। কারণ এই অর্জিত ধান এক বৎসর কালাতিক্রম করতে হবে। আর এর থেকে আগামী বৎসরের বীজ রাখতে হবে। তাই মনোযোগ সহকারী গুনতি করে ধান তোলা হতো। কথায় কথায় অনেক সময় হিসাব ভুল হয়ে যেতে পারে। পরিমান অনেক বেশী হওয়ায় দ্বিতীয় বার মাপাও কষ্টসাধ্য। সেই কারণেই ধান মাপার সময় কথা বলা বারণ।

****************************************

✍️ মুলচাঁদ মাহাতো

আজ এতটাই আপনাদের নিজ নিজ এলাকায় আরো যে সকল রীতিনীতি প্রচলিত আছে মন্তব্যের ঘরে উল্লেখ করুন সবার যথাসাধ্য উত্তর নিয়ে পরের সংখ্যায় হাজির হবো।

Wednesday, November 21, 2018

মুইঠ অনা

আজ অঘ্রাহায়ন পয়লা। চাষীর ঘরে মুঠ আনা আজ এক মজার অনুষ্ঠান। ভোরবেলায় চাষী স্নান করে নতুন কাপড়-চোপড় পরে কাস্তে নিয়ে মাঠে হাজির। জমির ঈশাণকোনে আড়াই মুঠি ধান আড়াই প্যাঁচে কেটে নতুন/ কাচা কাপড় জড়িয়ে মাথায় নিয়ে চুপটি করে সোজা বাড়ি। খামারে পালইয়ের সামনে রেখে দিয়ে শুরু হয় পুজো-অর্চনা অন্ন দেবী/ টুসু মায়ের আরাধনা।


বস্তুতঃ একটা সময় এই মুঠ আনার মধ্য দিয়েই গ্রাম বাঙলায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতো ধান কাটা। নতুন ফসল ওঠার মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ দিয়েই শুরু হতো বছর গণনা। কালের বিবর্তনে নিয়ম বদলেছে, তবে প্রথা কিছু রয়ে গেছে।
আদিবাসী কুড়মি/ চাষীদের কাছে ধান শুধু আহার্যবস্তুই নয়; অর্থনীতি থেকে শুরু করে লোক উৎসব - কৃষ্টি তথা লোকসংস্কৃতির বারো আনাই ধান কেন্দ্রিক। আষাঢ় থেকে পৌষমাস - আমনধানচর্যার যেন মহাকাব্যিক বিস্তৃতি।
 মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে। শুরু হয়েছে ধান কাটার মরশুম।।মাঠে ঘাটে সব জাইগাতে মানুষের ঢল, নাস্তাপানি খাওয়া-দাওয়া সবই মাঠে-ঘাটে। দূর-দূরান্তের  লোকজন, জন-মজুর খাটতে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের  বর্দ্ধমান (বর্তমান পূর্ব বর্দ্ধমান)বাঁকুড়া,মেদিনীপুর,পুরুলিয়া জেলার গাঁ-গঞ্জে। এখানকার লোকেরা বলে মুনিশ। পরিযায়ী পাখির মতো দুদ্দার ভিড় করে বছরে দুবার। ধান লাগানো আর এই ধান কাটায়।। ধান কাটা, গোঁচ বাঁধা - বিঁড়ে সাজানোয় এ অঞ্চলের মুনিশরা এক একজন সহজ শিল্পী। খাটো দিনের বেলা। দুপুরের আজান শুনেই কর্মবিরতি। বেলা ঢলতেই দিগন্তে কুয়াশার সঙ্গে আঁধার নামে গুটি গুটি পায়ে। জনহীন প্রান্তরে পড়ে থাকে মাঠের সোনালি শস্য - ধান!
গ্রাম বাঙলার মানুষের কাছে ধান শুধু আহার্য বস্তু নয়; সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুন। জুতো পায়ে বা আকাছা হয়ে ধানে হাত-পা ঠেকানো একেবারেই বারণ। কিম্বা জোরে শব্দ করলে গেরস্থরা রেগে টঙ। কারণ লক্ষ্মী বড়ো পয়মন্ত শান্ত দেবী। বেশী গোলমাল হলেই তিনি টুকুস করে কেটে পড়েন। আর সেই স্থান দখল করবেন রুক্ষকেশী অলক্ষ্মী!
 তাছাড়া ধান-চালের সঙ্গে আদিবাসী কুড়মি জনজাতির সম্পর্ক কী আজকের?
 সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন থেকে আমাদের  প্রত্ন-উৎখননে সর্বনিম্ন স্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে ধানচাষের প্রত্ন নিদর্শন। তারপর যতদিন গেছে ধানের সঙ্গে চাষীদের মন প্রাণ গেছে জড়িয়ে। ধান শুধু চাষিকে ধনবানই করেনি; দিয়েছে সম্মান। চাষীর কাছে ধানী জমি জোয়ান ব্যাটার সমান। আবার অর্থ থেকে পরমার্থের প্রতীক ধান। মানুষের বিয়ে-বা মাঙ্গলিক কর্মে দান-ধ্যানের সঙ্গে দুব্ব্যো ঘাস সহ ধান হয়ে উঠেছে আশীর্বাদের প্রধান উপকরণ। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থান থেকে প্রাপ্ত মৌর্য আমলের এক শিলালিপি। এতে খোদিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা ধান্যভান্ডারের কথা।
লক্ষণ সেনের আনুলিয়া, তর্পণদিঘি, গোবিন্দপুর, শক্তিপুর তাম্রশাসনগুলির মঙ্গলাচারণ শ্লোকে গাঁথা ধান্যবন্দনার কথিকা। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। বোঝা যায় প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল ধান। আজও তার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তাই ধানী জমি নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেললে তার পরিণাম যে ভয়ংকর । ধান কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি আর যাবতীয় লোকউৎসব আমনকে কেন্দ্র করেই। রামাইপন্ডিতের শূণ্যপুরাণ নাকি চর্যাপদের সমসাময়িক রচনা। এতে হরেক রকম আমনধানের কথা আছে যেমন কনকচূড়, কাঙুদ, কলমা, কসুমশালী, খিরখম্বা, গোতমপলাল, ঝিঙাশাল, সীতাশালী, লাউশালী, মুক্তাহার, মৌকলস, গৃহিনীপাগল, ইত্যাদি।  আগে গোবিন্দভোগ ধানের মাঠে ভুর ভুর করে সুগন্ধ ছড়াতো হেমন্তের বাতাস।
 তবে চাষীরা আর আপন মনে  গানে ভরিয়ে দেয়না বর্ষণসিক্ত আষাঢ়ের মাঠ-ঘাট...
নাগর কোথায় রইল্যা রে...
জল লেগেছে তোমার বাকুড়িতে।।
শ্রাবণ মাসের রিমিঝিমি বরিষণে ধান্যসুন্দরীরা গায়ে গতরে বেড়ে ওঠে। আসে তাদের নবযৌবন। ধান্যবতীরা হয়ে ওঠে গর্ভবতী। ধীরে ধীরে বিয়েন ছাড়ে। থোড় আসে। আর জমে ওঠে দুধ। আশ্বিনসংক্রান্তি হলো ধানের পূর্ণ প্রসব কাল। তারপরই পেকে ওঠার সময়। ধানিজমি যেন কৃষিলক্ষ্মীর আদিগন্ত সবুজ শাড়ি। লেগেছে তাতে সোনার পরশ। ধানের বনে হিমেল হাওয়া আর সোনা রোদের মাখামাখি, মাতামাতি। পরম তৃপ্তিতে পেকে উঠেছে আগুন রঙা ধান 

অঘ্রান মাস পড়তে না পড়তে মাঠের রঙ বদলাতে শুরু করে। আগুন রঙা ধান ক্রমশ পাকা সোনায় পরিণত। উদ্ধত ঋজু ধান এবার সকল অহংকার লুপ্ত করে ফলভারে নত। শুরু হলো ধান কাটা। এবার লঘু অর্থাৎ নতুন ধান্যে হবে নবান্ন গ্রাম বাঙলার ভবনে ভবনে...
****
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পোস্ট - সঞ্জয় মাহাত( হিন্দ্য়ার)




Sunday, September 16, 2018

' করম পরব ' - কুড়মালি কবিতা

ভাদর মাসে করম পরব
মুদের ঘরে ঘরে
বাঁজা মাটি গাভিন হবেক
বীজের ফোড়্যে ফোড়্যে ।
দাঁতন কাঠি বাঁশের টুপা
বালি ভরা ডালা
ডালা ঘিরে বিটি ছিল্যার
জাওয়া গানের পালা ।
তেল হলুদে কুত্থি জুনার
সিঁদুর কাজল লাগা
শাল পাতায়্যে বাঁট্যে দিয়ে
বাঁশ কঞ্চির দাগা ।
সিনান সারে ঝিঙাপাতায়

দাঁতন কাঠি রাখ্যে
করম ডাল পুঁতে সিথায়
আল্পনা দেয় আঁক্যে ।
গটা দিনই উপাস থাক্যে
বহু বিটিছিল্যায়
সঞ্ঝাবেলায় করম পূজায়
ফুলে ফলে সাজায় ।
রাত্যের বেলি লাচা গানা
ভাদু টুসু ঝুমুর
আইবুড়িরাই লাচে সবাই
বাঁধে পায়ে লুপুর ।
সকাল হল্যে জলে ভাঁসায়
করম গাছের ডাল
কুত্থি জুনার আঁকুরগুল্যান
ফিরায় গাঁয়ের হাল ।

Friday, August 17, 2018

বারি পূজা/ যাতাল/ মনসা পূজা


বারি পূজা র(মনসা) প্রকৃত/ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা ও বৈজ্ঞানিক কারন:-

==============================
       লেখা - সঞ্জয় কুমার মাহাত( হিন্দোইয়ার)
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
 আপনি জানেন কি? কুড়মি সমুদায় এর প্রত্যেক পরব - তিহার,পূজা - পাঠ, নেগ - নেগাঁচার এমন কি খাওয়া - দাওয়ার মধ্য দিয়েও কিছু না কিছু কারন লুকিয়ে আছে।। তা কেও জানার প্রয়োজন মনে করে না।ওই চলছে আর চলছে কিন্তু কি কারনে যে করে কেন করে, কি উদেশ্য কেও জনেই না।।                                                     ••আজ বারি পূজা/ মনসা পূজা নিয়ে কিছু কথা :-
                 বারি অর্থাৎ জল,বারি পূজা একচুয়েলি জল দেবীর / জল শক্তির পূজা।যা বর্তমানে  মনসা পূজা বা সর্প দেবীর পূজা নামে সবাই জানে। বারি পূজা( মনসা) বিশেষত চাষ আবাদ শেষ হওয়ার পরেই অর্থাৎ রূপা মাসের শেষের দিকেই পালন করা হয়ে থাকে।কিছু কিছু পরিবারে দেখা যাই চাষ আবাদ শেষ না হলে এই পূজা করেই না। তা হলে এখানে বুঝা যাচ্ছে এটা একটা কৃষি কেন্দ্রিক পূজা।                                                     চাষ আবাদ/ কৃষি কর্মএর সঙ্গে জলের গুরুত্ব বা জলের প্রয়োজন সর্ব প্রথমে আসে।আর জলের মধ্যে অনেক জীব - জন্তু,কীটপতঙ্গ থাকে সেগুলি জল ব্যতীত বেঁচে থাকা অসম্ভব এবং ওই জীব জন্তু গুলি বেঁচে থাকারও প্রয়োজন আছে।যেমন কেঁচো চাষের সঙ্গে অঙ্গা অঙ্গী ভাবে জড়িত।জলের মধ্যে থাকা জীব - জন্তু গুলি বাচার সাথে সাথে আমাদের প্রধান সম্পদ চাষ আবাদ/ ফসল রক্ষা করে একমাত্র জল( বারি) ।এক কথাই বলা যায় জল ছাড়া চাষ আবাদ করা অসম্ভব।সে কারণেই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা বংশ পরম্পরা চাষের শেষে জল দেবী কে সন্মধন জ্ঞেপণ বারি পূজা অর্চনা করে আসছে আদি কাল থেকেই ।যা বর্তমানে মনসা পূজা নামে জানা যাই।
     বর্তমান সময়ে বারি পূজা(মনসা) ব্রামনের কুটিল সড়যন্ত্রে ওদের লাভের জন্য ওদের যাতে "দান - মান - সন্মান" বজায় থাকে সেকারণে মনগড়া/ কাল্পনিক কাহিনী সাজিয়ে ধর্মের নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ওদের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে এক বিশাল মানব রুপী মূর্তি মনসার সৃষ্টি করেছেন।যা বাস্তবিক "বারি পূজার" সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।বারি পূজা কোন নতুন প্রথা নয়।এটা আমাদের পূর্ব পুরুষদের সময় থেকেই চলে আসছে,কিন্তু বর্তমানে যে মনসা মূর্তি পূজার বাড়বাড়ন্ত যা ৪০-৫০ সাল আগে হত না।তাই বলছি লোক দেখানো ফালতু খরচ খরচা থেকে বাঁচুন এবং শ্রদ্ধা থেকে মন থেকে ওই প্রকৃতি রূপকে ধন্যবাদ জ্ঞেপন "বারি পূজা" আরাধনা করুন ।
  
 •• বারি(মনসা) পূজাতে হাঁস বলির কারন:-
        আমাদের কৃষি কার্য জল ছাড়া সম্ভব নই।চাষের সময় আমাদের মাঠে - ঘাটে,খেতে - ক্ষামারে,নদী - নালা, বাঁধ - পুকুরে কাজ করতে হয়।বর্ষার সময় জলের মধ্যে অনেক ছোট বড় কিট - পতঙ্গের সঙ্গে দেখা/ মুলাকাত হয়ে থাকে এবং অনেকে কিট - পতঙ্গের শিকারও হয়ে যায়,এবং এখনো দেখা যায় চাষের সময় মাঠে - খেতে,নদী - নালাতে কৃষক গণ অনেক সময় জল পান করে থাকে।আগেতো অধিকাংশই চাষের সময় খেতে - নদী - নালাতে - পুকুরে জল পান করত।তাই মাঠে ঘাটে থাকা জীব জন্তুর বিষ থেকে বাঁচার জন্য চাষের শেষে হাঁসের মাংস  "বারি পূজার" সময় খেয়েথাকে।হাঁসের মাংস ও রক্ত মেডিসিনের মত কাজ করে।আপনারা শুনে থাকবেন হাঁসের মাংস ও রক্ত "লিভার টনিক" এর কাজ করে,এবং পেটের মধ্যে থাকা কৃমি কে নষ্ট করে।জলের মধ্যে থাকা "জোক" যদি  মানুষের শরীরে লেগে যায়,তাহলে জোক মানুষের রক্ত চুষে খাই এবং শরীর থেকে সহজে উঠে না।কিন্তু সেখানে হাঁসের রক্ত প্রয়োগ করলে সহজেই উঠে যায়।তাই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা চাষের শেষে বারি পূজার সময় হাঁস বলির প্রথাটা প্রচলন করেছেন ।

•• মূর্তি পূজার লাভ/ লোকসান:-

       এখন প্রতি গ্রামে গ্রামে মিনিমাম ৪-৫ জায়গাতে কম করে এর বেশিও হতে পারে মনসার মূর্তি পূজা করে থাকে ।আজকাল ত কম্পিটিশন করে মূর্তি পূজা হচ্ছে কাদের মূর্তি কত বড়।তাহলে চার - পাঁচ টি মূর্তির বিসর্জন করা হয়, তাহলে কম করে এক ট্রাক্টর মাটি আমাদের জলাশয়ে বা পুকুরে দেওয়া হচ্ছে, তা আবার প্রতি বছর।এর ফলে পুকুরের গভীরতা দিন দিন কম হচ্ছে।।অন্য দিকে আমাদের কুড়মি সংস্কৃতি নেগাচারিতে বারি পূজাতে কেবলমাত্র কিছু তুলসী আর বেলপাতা এবং কিছু ফুল দিয়ে করা হয়।যা বিসর্জন করলে জল শুদ্ধ হযে যায় এবং শেষে পাতা গুলি পঁচে মাছের খাবার হয়ে যায়,এতে করো কোন লোক শান নেই।
   •••এই সব নেগ নেগাচার গুলো সব বুড়া বাবার দান| " জয় বুড়া বাবা" জয় গরাম" জয় বুড়ি মাঁয়"

Thursday, August 16, 2018

ইতিহাসে ঠাঁই না পাওয়া ইতিহাস


ইতিহাসে নিজের নাম লেখাতে কে না চায়! কিন্তু এই খ্যাতিতে নাম তুললে যতটা সহজে মানুষের মনে পৌঁছানো যায়, কাজটা ততটাই জটিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শাসনকালে শাসকবর্গ ইতিহাস রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এপ্রথার বিলোপ হয় নি, আধুনিক শাসকবর্গও নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় দেখতে শকুন দৃষ্টি সর্বদাই জাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু ঘটনা হলো, ইতিহাস চর্চাতে ও ইতিহাসের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস, ইতিহাসের অবমাননা তো বটেই, ঘোর স্বার্থাণ্বেষীও বটে। 
            ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মানভূম আন্দোলনকে মোটামুটি দু'ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, স্বাধীনতার পূর্বের মানভূম আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পরের মানভূম আন্দোলন। 
           স্বাধীনতার পূর্বের মানভূম আন্দোলনের সংগ্রামী ইতিহাসের ইতিহাস রচনায় কলমের উপর ছড়ি চালানোর ইতিহাস আজো স্বমহিমায় বিরাজমান। 
                   নীল বিদ্রোহের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বলরামপুরেও। বলরামপুর ও সংলগ্ন বেড়াদা, বড়েদা, বুরুডি, লালডি সহ বিভিন্ন গ্রামে নীলের চাষ হত। নেকড়ে গ্রামে এখনও নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ রয়েছে। জলপা লায়া, গঙ্গানারায়ণ সিং, চয়ন মাহাত, বুলি মাহাত নামে কৃষক সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই বিদ্রোহ সে সময় বলরামপুর-সহ গোটা এলাকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করার পরে জমি জরিপ করে খাজনা নির্ধারণ করে। কিন্তু কৃষকরা খাজনা দিতে রাজি না হওয়ায় শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ। 1767 সাল থেকে বলরামপুর, বরাবাজার, কুইলাপাল, মানবাজার প্রভৃতি জায়গায় শুরু হয়ে যায় কৃষক বিদ্রোহ। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সংগ্রাম কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সেই সংগ্রামের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এই বলরামপুর। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় জলপা লায়া, গঙ্গানারায়ণ সিং দের নামগুলোতে বুর্জোয়াদের কলমের কালি শেষ হয়ে গেলো। চয়ন মাহাত, বুলি মাহাত রয়েগেলে আমাদের মনের প্রতিটি কোনায়। 
             1769 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1799 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চুয়াড় বিদ্রোহ চলে বিভিন্ন নেতার হাত ধরে। 1767 খ্রিস্টাব্দে ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম ধল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। 1771 সালে ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও ব্যর্থ হয়।  এপ্রিল 1778 সালে সরাইকেলা অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহের ডাক দেন। কিন্তু 5 ই এপ্রিল শিলির নিকট লোটা গ্রামে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। শহীদ রঘুনাথ মাহাতই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি শহীদ হন । কিন্তু 1798-99 খ্রিস্টাব্দে আবার দুর্জন সিংহ নিজেকে স্বাধীন তালুকদার ঘোষনা করেন ও কোম্পানির খাজনা দিতে অস্বীকার করেন ফলত তাকে গ্রেপ্তার ককরার নির্দেশ দেয় সরকার। 1798 সালের মার্চ মাসে রাইপুর পরগনায় শুরু হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। ক্রমে তা অম্বিকানগর, সুপুর, বাঁকুড়ার দক্ষিন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ সবচেয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, কিন্তু কোম্পানির সেনাদল নির্মম অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। নৃসংশভাবে বিদ্রোহীদের হত্যা করে তারা।গাছের ডালে তাদের ফাঁসি দিয়ে মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করে গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে। রাণী শিরোমণির আমলেও চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে এবং নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের দ্বারা চুয়াড়রা পরাজিত হয়। দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার রাণী শিরোমণিকে ওই বিদ্রোহের নেতা ভেবে 1799 খ্রীস্টাব্দে বন্দী করে।
        কিন্তু চুয়াড় বিদ্রোহের কমবেশী সব নেতারাই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিলেও শহীদ রঘুনাথ মাহাতোর ইতিহাস লিখতে ইতিহাসবীদদের পাতা শেষ হয়ে যায়। 
               1855 সালে সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ।
      কলিয়ান হরাম ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের লিপিকার এবং সাঁওতালদের গুরু। তিনি তাঁর "হরকোরেন মারে হাপরাম্বো রিয়াক কথা" শীর্ষক একটি রচনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত রেখে গেছেন। এই ইতিবৃত্তে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানুর সংগ্রাম-ধ্বনি, যথাঃ "রাজা-মহারাজাদের খতম করো", "দিকুদের গঙ্গা পার করে দাও", "আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই" প্রভৃতি লিপিবদ্ধ আছে। হ্যাঁ, এই সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরবদের সাথেই আন্দোলনের পুরোভাগে দায়ীত্বে ছিলেন গড্ডা জেলার চানকু মাহাতোর মতো বলিষ্ঠ যুবক। পরবর্তী 1856 সালে ফাঁসির দড়িতে জীবন ও ইতিহাস দুটোই বিসর্জন দেন। 
           ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া এলাকার বালিজুড়ি গ্রামে 1913 সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক শিক্ষার পরেই মাত্র 18 বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশকে ব্রিটিশ শাসনাধীন থেকে মুক্ত করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। ঝাড়গ্রাম এলাকায় জাতীয় কংগ্রেসের গুরুদায়ীত্ব পান। পরবর্তীকালে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পরে কারাবন্দী হন , তবু অহিংসের পথ ছাড়েননি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবারো বিপ্লবীক কাজে জড়িত থাকেন। পরবর্তী সময়ে আবারো দু'বার ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলবন্দি হন, তিনি আর কেউ নন, ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী মাননীয় অবিনাশচন্দ্র মাহাত মহাশয়। পক্ষাঘাতে প্রায় আড়াই বছর ধরে শয্যাশায়ী থেকে 25 শে মার্চ 2016 সালে 103 বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে সরকারী ভাতার তালিকায় নাম উঠলেও ইতিহাস মুখ ফিরিয়েছে। 
               1920 খ্রিস্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস এই কর্মসূচি গ্রহণ করে গান্ধিজিকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার সর্বময় দায়িত্ব অর্পণ করেন । জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলেন । অসংখ্য ছাত্র স্কুল, কলেজ বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল । দেশবাসীর উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে কাশী বিদ্যাপীঠ, বারাণসী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় । ডক্টর জাকির হোসেন, আচার্য নরেন্দ্র দেব, লালা লাজপত রায় প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ এই সব নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন । মতিলাল নেহরু, ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ আইনজীবীগণ আইন ব্যবসা ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন । সুভাষচন্দ্র বসু সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে এবং জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ হাইকোর্ট ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন । মহাত্মা গান্ধির ডাকে ডঃপ্রফুল্ল ঘোষ সরকারি উচ্চপদে ইস্তফা দিয়ে, প্রফুল্ল সেন, অজয়্ কুমার মুখার্জি উচ্চশিক্ষার মোহ বর্জন করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন । এভাবে একে একে মেদিনীপুরের যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, নদিয়ার হেমন্ত সরকার, বরিশালের যতীন সেন, ময়মনসিং -এর ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ******************* প্রমুখ আরও অনেকে তাঁদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে এগিয়ে এলেন । অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠল জাতীয় মুক্তিবাহিনী । শুধু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল নয়, দেশের শ্রমিক শ্রেণি কলকারখানা ছেড়ে এবং কৃষক শ্রেণি ও গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও এই অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন । সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, মেদিনীপুরের কৃষক, মহারাষ্ট্রের শ্রমিক, উত্তরপ্রদেশের ক্ষেতমজুর, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকলে এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন । ঘরে ঘরে ত্যাগের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল । সমস্ত দেশ জুড়ে গান্ধিজি যে অহিংস বাহিনী গড়ে তুললেন তারা পোশাকে স্বতন্ত্র, আচরণে বিনম্র, প্রতিজ্ঞায় অটল, এবং ব্যক্তিত্বে অনন্য । তাদের পরণে খদ্দরের ধুতি, মাথায় টুপি, প্রত্যেকেই যেন আত্মত্যাগ ও শুভ্রতার প্রতীক । অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, "আমরা দেখলাম যে সমস্ত গ্রামাঞ্চল উদ্দীপনার এক আশ্চর্য উন্মাদনায় ভরপুর ।" আমেদাবাদে গৃহীত এক সিদ্ধান্ত অনুসারে গান্ধিজি 1922 খ্রিস্টাব্দের 4 ফেব্রুয়ারি সুরাট জেলার বরদৌলিতে গণ আইন অমান্য  আন্দোলনের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেন । এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিপুল উত্সাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয় । কিন্তু এই  আন্দোলন শুরুর আগেই 1922 খ্রিস্টাব্দের 5 ই ফেরুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় একদল হিংসাত্মক জনতা এক পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন লাগিয়ে 22 জন পুলিশ কর্মচারীকে পুড়িয়ে মারে । গান্ধিজির কানে এই সংবাদ পৌঁছুলে তিনি তত্ক্ষণাৎ আন্দোলন বন্ধের আদেশ দেন । সারাদেশ তাঁর এই আদেশে স্থম্ভিত হয় । মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হন । কেউ একে 'জাতীয় বিপর্যয়' কেউ 'পর্বত প্রমাণ ভুল' বলে মন্তব্য করেন । তথাপি কংগ্রেস কার্য নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। (Class X- 6th chapter) 
     উপরি *************** চিহ্ন জায়গাতে পড়তে পড়তে আমিও বারবার ভেবেছি, এই বুঝি লেখা আছে, মানভূমের গোকুল মাহাত, গণেশ মাহাত, সহদেব মাহাত, শীতল মাহাত, মোহন মাহাত। 
       কিন্তু না, দুঃখিত, সেটা নেই। কলমের কালি সবার জন্যই কম পড়েছে। 
              
            মনে আছে?-'জঙ্গলমহলের "সিধু জ্যাঠা"-সুধাকর মাহাতকে। 1928 সালে ঝাড়গ্রামের "ধোবোধোবিন" গ্রামে জন্মগ্রহণ করে প্রাইমারী শিক্ষা শেষের পর 1940 সালে কুমুদকুমারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই বছরের 12 ই May বর্তমান দূর্গা ময়দানে সুভাষচন্দ্র বসু বক্তব্য রাখতে আসেন। সভায় যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন প্রধান শিক্ষক। নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে হাজির হন ঐ সভায়। তারপর যা হয় এই নন্দলালের দেশে, খবর পৌঁছায় প্রধান শিক্ষকের কাছে। বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। অপমানে তিনিও আর বিদ্যালয় মুখো হন নি। তারপর সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর ষাটের দশকে বাংলা-বিহার-ওড়িশ্যার জঙ্গলমহল এলাকা জুড়ে জল-জমি-জঙ্গলের উপর অধিকারের দাবীতে "বনবাসী আন্দোল" শুরে হলে আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্ত্ব দেন। একসময় (2003-2008) ঝাড়গ্রামের পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য হলেও ইতিহাসের পাতা কম পড়ে গেছে এই সব সংগ্রামীদের জন্য। 
           1942 সালের 8 ই আগস্ট, মহাত্মা গান্ধী ভারতছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে বিদ্যুৎ গতিতে তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। মানভূমেও সেই বিদ্যুচ্ছটা পৌঁছায়। এই সময় মানভূমের গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা শিল্পাশ্রম গুলো ছিল বিপ্লবীদের নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল। মানভূম জেলার ততকালীন জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষনেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ ও বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত এক সভা থেকে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হলে আন্দোলনকে দূর্বল করতে শিল্পাশ্রম গুলো ঘেরাও করে শীর্ষনেতাদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু মানভূমের মানুষদের জাত চিনতে পারে নি, ব্রিটিশ সরকার। 
            এই সময় আন্দোলনকে দূর্বার গতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুভার এসে বর্তায়, 'ভজহরি মাহাতো', 'ভীম মাহাতো', 'হেমচন্দ্র মাহাতো', 'কুশধ্বজ মাহাতো'-দের মতো তারুণ্যে ভরা বিপ্লবীদের উপর। তারপর বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে নবীন নেতারা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনার ডাক দেন। 
             ব্যাস, তারুণ্যে ভরা বিপ্লবীরা তো পিছু হটতে নারাজ। ইতিহাস গবেষক প্রদীপ মন্ডলের কথায়, 1942 সালের 29 শে সেপ্টেম্বর বান্দোয়ান ও বরাবাজার থানা দখল করে যৌবনে বরা বিপ্লবীর দল। থানাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, স্থানীয় মদ, ভাটি, ডাকঘর, পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়া হয়। পথে ঘাটে গাছের কুঁড়ি কেটে রাস্তা অবরোধ করা হয়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে টেলিফোন ব্যবস্থা কেটে দেওয়া হয়। এই সময়, ব্রিটিশ পতাকা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো সাহস দেখাতে পেরেছিল এই তরুণের দল। সেদিনই স্বপ্নের সেই উড়ান জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা প্রথম উড়েছিল মানভূমের বুকে। কিন্তু না, এ ঘটনা ইতিহাস হয় নি, ঠাঁই পায়নি ইতিহাসের পাতায়। এ ঘটনা ইতিহাস হলে কংগ্রেসী নেতাদের যে মুখ পুড়তো। 
           পরেরদিন, 30 শে সেপ্টেম্বর কয়েকশো সত্যাগ্রহী মানবাজার থানা ঘেরাও করেন, কিন্তু এ যে মীরজাফরের দেশ, পুলিশের কাছে আগাম খবর থাকায় থানা চত্ত্বরে ঢোকা মাত্র নির্মম ভাবে গুলি চালায় পুলিশ। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তরুণ দুই তাজা প্রান- শহীদ গোবিন্দ মাহাত ও চুনারাম মাহাত।(সুত্র: সমীর দত্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা,14 ই আগস্ট 2017)
              ভজহরি মাহাতো পরবর্তীকালে মানভূমের সাংসদের তালিকায় ঠাঁই হলেও ইতিহাসের কালি শেষ হয়ে গিয়েছে। এমনকী ঠাঁই হয় নি, শহীদ গোবিন্দ মাহাতো ও চুনারাম মাহাতো দের জন্যও কালিও পাতা দুটোই কম পড়েছে। 
         বঙ্গভুক্তি ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যাবে যে, 
                    1765  খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলম বক্সারের যুদ্ধেপরাজিত হলে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেবিহার ও উড়িষ্যা সমেত সমগ্র বাংলার দেওয়ানী দিতে বাধ্য হন। কোম্পানি বাংলার জঙ্গলমহল এলাকায় কর সংগ্রহ করা শুরু করলে তাঁরা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই এলাকাকে 1773 খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্চেত, 1805 খ্রিষ্টাব্দে জঙ্গল মহল এবং 1833 খ্রিষ্টাব্দে মানভূম এই তিন ভাগে ভাগ করেন। মানভূম জেলার সদর দপ্তর হয় মানবাজার। এই জেলা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলা ও বর্ধমান জেলা এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের ধানবাদ, ধলভূম ও সেরাইকেলা খার্সোয়ান জেলারঅংশ নিয়ে 7896 বর্গমাইল এলাকা জুড়ে তৈরী করা হয়।  পরবর্তীকালে 1845, 1846, 1871 ও 1879 খৃষ্টাব্দে মানভূমকে আরো ভাগ করা হয়। 1911 খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র মানভূম ও ধলভূম জেলাকে নতুন তৈরী বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত করা হয়।  এই বিভক্তির ফলে ঐ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ জানালেও ঐ সিদ্ধান্ত রদ হয়নি। জাতীয় কংগ্রেসের 1920 খ্রিষ্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবী আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু 1935 খ্রিষ্টাব্দে বিহারে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব লাভ করার পর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে 'মানভূম বিহারী সমিতি' নামক এক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর বিপরীতে মানভূম জেলার বাঙ্গালীরা ব্যারিস্টার পি আর দাসের সভাপতিত্বে 'মানভূম সমিতি' নামক সংগঠন তৈরী করেন। বিহার সরকার আদিবাসী ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় খুলতে শুরু করলে বাঙ্গালীরাও বাংলা স্কুল খুলতে তৎপর হয়ে পড়েন। এই সময় সতীশচন্দ্র সিংহ রাঁচি, পালামৌ, সিংভূম ও মানভূম জেলা নিয়ে ছোটনাগপুর নামক এক নতুন প্রদেশ গঠন বা বাংলার সঙ্গে পুনরায় সংযুক্তির প্রস্তাব করেন।
              1947 খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে জাতীয় কংগ্রেসের ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের নীতির বাস্তব রূপায়নের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিকতা বেড়ে উঠতে শুরু করে। সেই পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীজওহরলাল নেহরু দেশের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তাকে বিবেচনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করেন এবং সেই হিসেবে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন বা দার কমিশন নিয়োগ করেন। 1948 খ্রিষ্টাব্দে্র ডিসেম্বর মাসে কমিশন মত দেয় যে, স্বাধীনতার সাথে সাথে জাতীয় কংগ্রেস তাঁর অতীত অঙ্গীকার থেকে অব্যহতি পেয়েছে এবং শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন না করে ভারতের ঐক্যবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এই কমিশনের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের এক উচ্চপর্যায়ের কমিটি নিয়োজিত হয়

     1948 খ্রিষ্টাব্দ থেকে তৎকালীন বিহার সরকার ঐ রাজ্যের মানুষদের ওপর হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক স্তরে ও সরকারি অনুদান যুক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দী মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ আসে, জেলা স্কুলগুলিতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয় ও হিন্দীকে বিহার রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

        এই সময় বাঙলাভাষী সংগঠনের ঘৃণ্য চক্রান্ত সফল হয়। তারা মানভূমের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কুড়মী ভাষী অধ্যুষীত মানুষদের ভুল বোঝায়। এবং কিছু মানুষ সেই ফাঁদে পা দিয়ে এক বৃহৎ ভাষার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। আর সেই দিন থেকেই শুরু হয় মানভূমের অবক্ষয়।  জেলার বাংলাভাষী মানুষদের ক্ষোভ আঁচ করে জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র মুক্তি পত্রিকায় 1948 খ্রিষ্টাব্দের  8 ই মার্চ হিন্দী প্রচার, বাংলা ভাষাভাষীদের বিক্ষোভ ও মানভূম জেলার বঙ্গভুক্তির যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশি হয়।  এই বিষয়টি বিবেচনার জন্য 1948 এর  30 শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে জেলা কমিটির অধিবেশন হলে সেখানে প্রতিনিধিদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ঐ বছর 30 শে মে পুরুলিয়াশহরের অধিবেশনে মানভূমের বঙ্গভুক্তির প্রস্তাব 55-43ভোটে খারিজ হয়ে গেলে অতুলচন্দ্র ঘোষ সহ সাইত্রিশজন জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে 1948 খ্রিষ্টাব্দের 14 ই জুন পাকবিড়রা গ্রামে লোক সেবক সংঘ তৈরী করেন। বিহার সরকারবাংলাভাষীদের প্রতিবাদসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করলে মানভূম জেলায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। লোক সেবক সংঘ 1949 থেকে 1951 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং 1954 খ্রিষ্টাব্দের 9 ই জানুয়ারি থেকে 8 ই ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগদান করে। হাজার হাজার বাংলাভাষী মানুষ কারাবরণ করে। এই সময় বেশ কয়েকটি টুসু সঙ্গীত জনগনের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হল,

শুন বিহারী ভাই 

তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্গ দেখাই
       এই সময় জননিরাপত্তা আইনের 9 এর 5 নং ধারায় 17 জন টুসু সত্যাগ্রহী এবং ভারতীয় দন্ডবীধির 143, 225,186 ধারায় লোকসেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভার সাংসদ ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপারভা ঘোষ, অরুনচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অতুলচন্দ্র ঘোষকে হাজারীবাগ জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। লোকসভার সদস্য ভজহরি মাহাতো মহাশয়কে সাধারণ অপরাধীদের সাথে হাতকড়াই বেঁধে, কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে আনা হয়, বিচারে 11 মাসের কারাদন্ড হয়। লাবণ্যপ্রভা দেবীকে 1 মাসের কারাদন্ড ও 100 টাকা জরিমানা করা হয়। অরুনচন্দ্র ঘোষ, মানবাজার থানার গগ্দা গ্রামের অমূল্যভূষণ মাহাতো সহ পাঁচজনকে 14 মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। অশোক চৌধুরী, রামচন্দ্র অধিকারী সহ আরো 23 জন আন্দোলনকারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের শাস্তি দেওয়া হয়। 
আশ্চর্য্যের ঘটনা হলো যে, যেটা মনে হয় পৃথিবীর যে কোন আন্দোলনে বিরলতম ঘটনা। বাবুলাল মাহাতো নামে এক 15 বছরের জন্মান্ধ কিশোরকে 3 মাসের কারাদন্ড ও 200 টাকা জরিমানা করা হয়, এবং 9 বছরের সুধন্ধাকে 9 মাসের কারাদন্ড ও 1000 টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা আদায়ের জন্য সুধন্ধার বাড়িতে পুলিশ 21 শে ফেব্রুয়ারী মালামাল ক্রোক করার চেষ্টা করে। এছাড়াও জরিমানা আদায়ের নামে মানবাজার থানার পিটিদারী গ্রামে দন্ডপ্রাপ্তদের বাড়িতে পুলিশ তালা ভেঙে ঢুকে নারীদের প্রতি আপত্তিকর আচরণ করে।

         এই আন্দোলনের ফলে 1953 খ্রিষ্টাব্দের 29 শে ডিসেম্বর ভারত সরকার সৈয়দ ফজল আলির সভাপতিত্বে, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও কবলম পানিক্করকে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরী করে। এই কমিশন 1955 খ্রিষ্টাব্দের 5 ই ফেব্রুয়ারি থেকে মানভূম জেলায় তদন্ত করে ঐ বছর 10 ই অক্টোবর তাঁদের বক্তব্য জমা দেন। তাঁদের বক্তব্যে মানভূম জেলা থেকে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে 19 টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা নামে এক নতুন জেলা তৈরী করার প্রস্তাব দেন। তাঁরা মানভূম জেলা থেকে ধানবাদ মহকুমার 10 টি থানা ও পুরুলিয়া মহকুমার 2 টি থানা বিহার রাজ্যে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। অপরদিকে ধলভূম পরগণায় বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বীকার করেও যেহেতু ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ ঐ জেলায় বসবাস করেন সেই কারণে কমিশন জামসেদপুরকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে বা ধলভূম পরগণা ভেঙ্গে বাংলায় আনতে রাজি ছিলেন না। এই প্রস্তাবে 1956 খ্রিষ্টাব্দের 17 থেকে 20 শে জুন বিহারপন্থীরা মানভূম জেলায় ধর্মঘটের ডাক দেন। অপরদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা ধানবাদ বিহারের অন্তর্ভুক্তিতে খুশি ছিলেন না


      1956 খ্রিষ্টাব্দের 23 শে জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার উভয় রাজ্যের সংযুক্ত করে পূর্বপ্রদেশ নামে এক নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবনা করেন। তাঁরা প্রস্তাব দেন যে, ঐ প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দী ও বাংলা উভয়েই স্বীকৃত হবে, মন্ত্রীসভা, বিধানসভা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি করে থাকলেও হাইকোর্ট থাকবে দুইটি। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা ছাড়াও বামপন্থী দলগুলিও প্রতিবাদ করেন। দুই রাজ্যে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্যে বিহার বিধানসভায় 24 শে ফেব্রুয়ারী প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়। লোক সেবক সংঘের কর্মীরা  মাননীয়া ভাবিনি মাহাতো ও লাবণ্যপ্রভা ঘোষ এর নেতৃত্বে  1956 খ্রিষ্টাব্দের 20 শে এপ্রিল পাকবিড়রা গ্রাম থেকে বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান, পান্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, হাওড়া হয়ে কলকাতাশহরের দিকে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা শুরু করে 6 ই মে কলকাতা পৌঁছায়, 7 ই মে মহাকরণ অবরোধের কর্মসূচী অনুসারে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ পৌঁছছে 956 জন কারাবরণ করেন। এই ঘটনার তিন দিন আগে 4 ঠা মে উভয় রাজ্যের সংযুক্তির প্রস্তাবনা বাতিল হয়ে যায়।


    1956 খ্রিষ্টাব্দের 17 ই আগষ্ট বাংল-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল লোকসভায় ও 28 শে আগষ্ট রাজ্যসভায় পাশ হয়। 1st সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন। এর ফলে 1956 খ্রিষ্টাব্দের 1st নভেম্বর 2407 বর্গ মাইল এলাকার 11,69,097 জন মানুষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়া তৈরী হয়। সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা বিহার রাজ্যে রয়ে যায়।

                  এরপরো আমরা 1971 র  21 শে জুলাই দিনটিকে ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে পালন করি। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, ভাষা আন্দোলন প্রথম শুরু হয় মানভূমের বুকেই, 1912 সালে।বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বাঙলাকে ততকালীন বিহারের সাথে যুক্ত করলে তথাকথিত ততকালীন মানভূম নিয়ে সব থেকে বেশী ঝামেলায় পড়ে। এখানের ভাষা না হিন্দী, না বাঙলা। এক স্বতন্ত্র ভাষা কুড়মালী তথা মানভুঁই ভাষা। এই বৃহত্তর অঞ্চলের স্বাধীন ভাষীদের উপর বাঙালীর চক্রান্তে কিছু কুড়মী সেই ফাঁদে পা দিয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু হায়রে মানভূম, তোর যে পোড়া কপাল, ইতিহাসের এদিকে আসার যে নুন্যতম ট্রেন যোগাযোগও নেই। তাইতো শহীদেরা উপেক্ষিত আর কংগ্রেসী পত্নীদ্বয় একজন হলেন মানভূম কেশরী আরেকজন হলেন মানভূম জননী, যে কিনা বৃহত্তর এলাকার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাষাকে বাঙলা বলে চালিয়ে দিয়ে ইতিহাস থেকে  এক স্বাধীন ভাষার অবলুপ্তি ঘটিয়ে হয়ে গেলেন মানভূম জননী।
         ভারতের প্রথম পতাকা জাতীয় তেরঙ্গা উত্তোলিত হয় এই মানভূমেই। প্রণাম তোমায়। আর মানভূমের ইতিহাস লিখতে হলে ঐ কালি আর কাগজে কুলানো যাবে না। তাই থাক, আপনাদের আর কাগজ নষ্ট করতে হবে না, এই ইতিহাস মানভূম বাসীর গর্বের ইতিহাস। আপনাদের কালির আঁচড় মুছে যাবে, কিন্তু প্রতিটি মানভূম বাসীর হৃদয়ে এই গর্বের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
                   শহীদ রঘুনাথ মাহাত অমর রহে
                   শহীদ গোবীন্দ মাহাত অমর রহে
                   শহীদ চুনারাম মাহাত অমর রহে
                                     জহার
                                   (Reference: Wikipedia)
" ইতিহাসে ঠাঁই না পাওয়া ইতিহাস"
                            ---সুজিত কুমার মাহাতো

Wednesday, August 15, 2018

স্বাধীনতা আন্দোলনে কুড়মিরা


যে জাতি নিজের ইতিহাস জানে না, সে জাতি নিজের ভবিষ‍্যৎ তৈরী করতে পারে না। তাই নিজের ইতিহাসকে জানুন।এই বৃহৎ ঝাড়খণ্ডে সবচেয়ে বেশি জনসংখ‍্যা আছে তা হল কুড়মিদের। আপনাদের জানার ইচ্ছা হয় না এত বড় জনসংখ‍্যা বিশিষ্ট জাতি আর দেশের স্বাধীনতা সংগ্ৰামে তার অবদান কি? আমি ছোট থেকে যে ইতিহাস পড়েছি তাতে কোথাও কোনোকিছু খুঁজে পায়নি। এই সমাজ আন্দোলন এর সাথে যুক্ত হয়ে এদিক ওদিক থেকে সঠিক খবর সংগ্ৰহ করলাম। আর দেখলাম আমার জাতির অবদান। সেই চূয়াড় বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত যতজন কুড়মি শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব করা মুশকিল। তবু এখানে আমি তাদের অনেকের নাম বলব এবং তাদের কৃতিত্বের কথা লিখব।
এখনতো অনেকে সবাই জেনেই গেছেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্ৰামে দেশের প্রথম শহীদ রঘুনাথ মাহাতোর নাম। যিনি ঐতিহাসিক চূয়াড় বিদ্রোহের ধলভূমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যাকে ব্রিটিশেরা গুলি করে হত‍্যা করেছিল।চূয়াড় বিদ্রোহের সময় রঘুনাথ মাহাতোর সহযোগী প্রসাদী মাহাত ধানবাদ জেলায় নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও চুড়ু মাহাত বেলিয়াপুর ধানবাদ জেলার  রঘুনাথ মাহাতোর সহকারী ছিলেন।এরপর আসি বুলি মাহাতোর কথায় যিনি গঙ্গা নারায়ণ সিং এর সাথে দ্বিতীয় চূয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।এছাড়াও ঝগড়ু মাহাতো ছাড়াও অনেকে শহীদ হন। এরপর আসি নীল বিদ্রোহের 1843-1848 গোপাল মাহাতো নেতৃত্ব দেন। এরপর সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় গড্ডা জেলায় চানকু মাহাতো নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও সিপাহী বিদ্রোহে সুকদেব মাহাত সহ এগারোজনের একসাথে ফাঁসি হয়।এছাড়াও উড়িষ‍্যার মেড়ি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বকা মাহাত,রজনী মাহাত, সুচাঁদ মাহাত,কালিচরণ মাহাত, গোপিনাথ মাহাত, কালিয়া মাহাত প্রমুখ অংশগ্ৰহণ করেন। এরপর কুড়মিরা অহিংস অসহযোগ আন্দোনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্ৰহণ যোগ দেয়। এই আন্দোলনে পাঁচজন তরতাজা কুড়মি যুবক শহীদ হন। এরা হলেন গোকুল, মোহন, শীতল, সহদেব, গণেশ মাহাতোরা। এছাড়াও অনেকের তখন জেলও হয়। মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান‍্য আন্দোলনের সময় হাজারিবাগ জেলে বন্দি হয়েছিলেন গিরীস মাহাতো, নানকু চন্দ্র মাহাতো, গোবিন্দ মাহাতো, দশরথ মাহাতো,চুনারাম, মথন মাহাতো প্রমুখেরা। এছাড়াও ভাগলপুর জেলে বন্দি হয়েছিলেন পদক মাহাতো। 1941সালে সত‍্যাগ্ৰহ করার জন‍্য সাগর মাহাত, ভজহরি মাহাত, ভীম মাহাত কারাবরণ করেন। এছাড়াও 1942 সালে সত‍্যকিঙ্কর মাহাতোকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মানবাজার থেকে কারাবরণ করতে হয়। 1942 সালে মানবাজার থানা ঘেরাও করার সময় চুনারাম মাহাতো এবং গোবিন্দ মাহাত শহীদ হন। এছাড়াও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্ৰহণ করেছিলেন(ধানবাদ-পারবাসনিয়া)এর জগদীশ মাহাত, এছাড়াও ঐ জেলারেই জগদীশ মাহাত সক্রিয় অংশগ্ৰহণ করেন।এছাড়াও আরো অনেকের অংশগ্ৰহণ আছে। 
এই কুড়মি জাতি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই সি এন টি আ্যক্ট আদায় করে নিয়েছিল এবং এস টি তালিকায় নামও ছিল কুড়মিদের। কিন্তু আজ স্বাধীনভারতে সি এন টি আ্যক্ট থাকা সত্বেও আইনের ফাঁকে কুড়মিদের জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর ষড়যন্ত্র করে এস টি তালিকা থেকে হটিয়ে দিয়ে আজ বৃহৎ ঝাড়খণ্ডকেই বিহারী ইউ পি এবং বাঙালরা উপনিবেশ করে ফেলছে। তাই এত রক্ত ঝরিয়েও এখনো এ জাতি পরাধীন। তাই এ পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন‍্য সমগ্ৰ বন্ধুদের অনুরোধ করব, সবাই লড়ুন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - Rakesh Mahato 

জয় ঝাড়খণ্ড।
জয় ভারত। 
জয় গরাম।
কুড়মী একিন জিন্দাবাদ।

Tuesday, May 29, 2018

কুড়মালি ক্যালেন্ডার -২৭৬৮

ডাউনলোড করুন কুড়মালি ক্যালেন্ডার -২৭৬৮
নিচের লিংক থেকে
👉 https://drive.google.com/file/d/12wa-tY3bQANpE5wFHIRo-_PEutK0XcMJ/view?usp=drivesdk


--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------























Monday, May 28, 2018

মহিষ রাজার আসল ইতিহাস ।


তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে শেষ অবধি ৪২ ডিগ্রি গরমে নেতারহাট পৌঁছতে হল। প্রায় ফার্নেস হয়ে-যাওয়া টিনের কৌটোর মতো লজ্‌ঝড়ে বাস। মানুষ, হাঁসমুরগি ও ছাগলের গাদাগাদি ভিড়। এই বাসটাই আমাদের পৌঁছে দেবে ঝোবিপাট। মহিষ রাজার এলাকায়।
এখানে গ্রামগুলির নাম এ রকমই। ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাট। এই লাল মাটির জঙ্গলে পাট মানে উঁচু জায়গা। বাস রাস্তা থেকে ওই সব গ্রাম ঘণ্টা দুয়েকের হাঁটাপথ।
এই সব পাটেই অনিল অসুর, ললিত অসুর, সুষমা অসুরদের বাস। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে অনেকের ঘরেই আলো জ্বলে না, গায়ে নতুন কাপড় ওঠে না। তাঁদের পূর্বপুরুষ মহিষ রাজাকে দুর্গা নামে বহিরাগত এক সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে অশৌচ পালনের দিন।
ঠিক কী ছিলেন এই মহিষ রাজা? স্বর্গ-মর্ত তছনছ করে দেওয়া এক ভয়ংকর অসুর, যাঁর হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু সব দেবতাকে নিজের শক্তি দিয়ে ডাকতে হল মহামায়াকে? না কি প্রজাপালক এক নৃপতি, যাঁকে নারীর মোহিনী মায়ায় বশ হয়ে শেষ অবধি মৃত্যু বরণ করতে হল? অসুরই বা কারা? দেবতাদের স্বর্গরাজ্য বা মুনিঋষিদের তপোবনে সন্ত্রাসের হানা দেয় যারা?
কিন্তু ঋগ্বেদ তো উলটো কথাই বলছে। মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্র সব বৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সবিতৃ বা সূর্যদেবও ‘সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।’ ঋগ্বেদই জানিয়ে দিল, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়। শক্তিমান এক পুরুষ।
এই ক্ষমতাশালী অসুর-পুরুষ আসলে বিশ্বস্রষ্টা। পার্সি ধর্মের ‘জেন্দ আবেস্তা’র একমাত্র ঈশ্বর: আহুর মজদা। ম্যাক্সমুলার থেকে মনিয়ের উইলিয়াম্স, অনেকেই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, আহুর এবং বৈদিক সংস্কৃতির অসুর অনেকটা এক। খ্রিস্টের জন্মের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ইরাকের কাছে যে আসিরীয় সভ্যতা ছিল, সেখানেও ছিলেন এই আহুর মজদা। আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের এক শিলালিপিতে কিউনিফর্ম সংকেতে রয়েছে ‘আসুর মজদা’র উল্লেখ।
শিলালিপিটা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে আসুরবানিপাল আসিরিয়ার রাজা হয়েছিলেন। শিলাপটে তাঁর সিংহ শিকারের কিছু ছবিও রয়েছে। মহিষ রাজার খোঁজে এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বে সিংহশিকারী এক নৃপতিকে পাওয়া গেল। ভাষাতত্ত্বের খেলায় প্রাচীন আসিরিয়া, অসুর এবং আহুর একদেহে হল লীন।
অসুরেরাও দেবতা। প্রমাণ: রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। সেখানে দেবতা ও অসুর দু’পক্ষই প্রজাপতির পুত্র, বৈমাত্রেয় ভাই। ইন্দ্রের শ্বশুরমশাই পুলোমা এক অসুর। ভক্ত প্রহ্লাদও হিরণ্যকশিপু নামে এক অসুরের পুত্র। কশ্যপ ঋষির ছেলে ময় দানব হয়েও দেবতাদের অলকাপুরী নির্মাণ করে। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদও বানায়। তার বউ এক অপ্সরা, নাম হেমা। দেবাসুরের সংগ্রাম তাই শুধুই যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীসংঘর্ষের কাহিনি নয়। সকলেই আত্মীয়, তাদের মধ্যে বিয়ে-থা’ও হয়।
মহিষ রাজার খোঁজে বেরিয়ে সেই শক্তিমান অসুর পুরুষকে দেখেছিলাম মহীশূরের চামুণ্ডি পাহাড়ে। মহিষাসুর আর তাঁর দুই সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে এই পাহাড়েই বধ করেছিলেন দুর্গা। মহিষাসুর থেকেই কালে কালে অপভ্রংশে মহীশূর নাম। চামুণ্ডি মন্দিরের প্রবেশচত্বরেই বিশাল মূর্তি। গোঁফ ও গালপাট্টাসহ রাজার মতো দাঁড়িয়ে, এক হাতে খড়্গ, আর এক হাতে সাপ। মহিষাসুর মানেই সিংহের আক্রমণে ত্রস্ত, দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ কোনও মহিষরূপী দানব নয়।
খুঁজতে খুঁজতে মহিষ রাজার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের পাওয়া গেল এই বাংলায়। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানে। বাগানের শেষ প্রান্তের কারি লাইনে রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা খুড়ো অসুর জানালেন, ‘দুর্গাপুজোয় আমরা যোগ দিই না, কারণ সেখানে মহিষাসুরকে হত্যা করা হয়েছিল। সে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল।’
এই অসুরেরা সকলেই ঝুপড়িতে থাকেন। মহিলারা বাগানে চা-পাতা তোলেন, পুরুষেরা বেশির ভাগ সময় দিনমজুরের কাজে ভুটান চলে যান। সেখানে দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরি। কেউ আবার ভুটান থেকে আসা বস্তায় বাঁধা কাঁচা সুপারি গাড়িতে তোলার কাজ করেন। মেটেলি আর মালবাজারের চা-বাগানে আরও কয়েক ঘর অসুর আছেন। সেখানেই ওঁরা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতান।
কিন্তু ধর্ম? ১৮৮০ সালে ক্যারন চা-বাগানের পত্তন। সেই সময় রাঁচি ও ছোটনাগপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুলির কাজে নিয়ে আসা হয় ওঁদের। আগে জঙ্গলে শিকারও করতেন, নিজেদের হিন্দু এবং শিবের উপাসক বলে পরিচয় দিতেন। মহিষাসুরের উত্তরাধিকারী আদিবাসী অসুর এবং শিবপুজো করা কিরাতদের একাকার হওয়াতেই ভারতীয় ঐতিহ্য।
বাগানের ১০১টি অসুর-ঘরের মধ্যে ৯০টিই আজ খ্রিস্টান। ৮০ বছরের বর্গী অসুরের ছেলে ও নাতিরা যেমন! ‘আমি নতুন জীবনে গিয়ে হয়তো মানাতে পারব না। ছেলেপুলেরা বাগানে পাতা তোলে, আমিও আজীবন ওই কাজটাই করেছি। নতুন ধর্ম যদি ওদের একটু ভাল রাখে!’

বাগানের শেড ট্রিতে বসে বর্গী বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় দুর্গাপুজোটা খুব খারাপ লাগত। চার দিকে হইচই, কিন্তু মা আমাদের ঘরের বাইরে বেরোতে দিত না। বলত, বেরোলেই অলুক্ষুণে কিছু ঘটবে। পরে দেখলাম, বন্ধুবান্ধবরাও আমার পদবি নিয়ে ঠাট্টা করে। এখন আমরা আর কিছু লুকোই না। বছরে দু’বার, ফাল্গুন মাসে আর দশেরায় আমরা অসুরবাবার পুজো করি।’ বর্গীর পাশের বাড়ির তরুণী ললিতা অসুর শুনতে শুনতে পালটা ঝাঁজি মেরে উঠল, ‘আ মোলো! আমি মহিষাসুরের বংশধর হতে যাব কেন? দাদু, আমাদের এখানে তো অনেকে টোপো, কাজুর এ সব পদবিও নিয়েছে গো!’
মহল্লার একমাত্র অনসুর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জগন্নাথ মাহাতো। সবাই ডাকে মাস্টারজি বলে। তাঁর আক্ষেপ, ‘ওরা আজকাল অনেক বদলে গিয়েছে। আগে শিকার করে অনেক মাংসই খেত, এখন রান্নার ধরনধারনও তেল-হলুদ-সর্ষেবাটা দিয়ে আমাদের মতোই।’
শুধুই রন্ধন এবং ধর্মসংস্কৃতি নয়। একশো-দেড়শো বছর ধরে বিভিন্ন চা-বাগান ও খাদানের কুলি লাইনে হতদরিদ্র অভিবাসী হতে হতে অসুরেরা হারিয়েছেন নিজস্ব ভাষা। ১৮৭২ সালের জনগণনায় ১৮টি জনজাতির কথা বলা হয়। সবচেয়ে বেশি লোক ছিলেন অসুরদের মধ্যে। ১৭৪ বছর পর সেই অসুরেরা আজ ঝাড়খণ্ডের এক ‘আদিম জনজাতি’— প্রিমিটিভ ট্রাইব। তাঁদের বেশির ভাগ সময় মুণ্ডাদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, অাসুরি ভাষাকে মুণ্ডারি উপভাষার মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তিন বছর আগেও গণেশ দাভি-র ‘পিপ্‌লস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, অাসুরি সহ ভারতের প্রায় দেড়শোটি ভাষা ধবংসের মুখে। মহিষ রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ট্র্যাজেডি ক্রমে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবহেলায় কী ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে জনজাতিদের নিজস্ব ভাষা, গান, উপকথার মৌখিক সংস্কৃতি।
পশ্চিমবঙ্গও এ ব্যাপারে সমান দায়ী। গত বছর কোজাগরী পূর্ণিমায় পুরুলিয়ায় চরণ মাহাতো, সুষেণজিৎ বৈরাগীরা ‘মহিষাসুর দিবস’ পালন করছিলেন।  পুরুলিয়ায় সুষেণজিতের পুজো মণ্ডপে এসে স্থানীয় পুলিশ অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে। সুষেণের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘প্রিয়জন মারা গেলে আজকাল পুলিশের থেকে অশৌচেরও অনুমতি নিতে হয়?’ পুলিশ কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। সিধু-কানুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করলেই হয় না, আদিবাসীদের বিপন্ন সংস্কৃতির কথাও বুঝতে হয়।
সেই সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছিলেন রাঁচির সমাজকর্মী, ‘ঝাড়খণ্ডী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আখড়া’র বন্দনা টেট, ‘শুধু অসুর নয়, সাঁওতাল এবং পোকরুদের উপকথাতেও আপনি মহিষ রাজা এবং দুর্গা তাকে কী ভাবে মোহিনী রূপে ভুলিয়েভালিয়ে বধ করলেন, সেই গল্প পাবেন।’ এই আখড়া বা পরিষদের তরুণী সুষমা অসুরই অাসুরি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত কবি। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল্যাংগোয়েজ ফেস্টিভ্যালে তাঁর কবিতার বই ‘অসুর সিরিং’ নিয়ে গিয়েছিলেন: ‘খেতো মে যব হুল চলাওগে/ তব ধান বোয়েগে/ নহি তো ঘাস আ জায়েগা।’ রাঁচি, নেতারহাটের মালভূমিতে রোজকার হতদরিদ্র জীবন নিয়ে একটি মেয়ের কবিতা। সুষমারা সম্প্রতি ফেসবুকে ‘অসুর আদিবাসী ডকুমেন্টেশন ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি ওয়েব পেজও খুলেছেন। মহিষ রাজার উত্তরপ্রজন্মে ক্লাস টুয়েল্ভ পাশ এক মেয়ে কবিতা লিখে, সংগঠন তৈরি করে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একুশ শতকের দশভুজা। নেতারহাটের রোদ-জ্বলা টাঁড়ভূমিতে মহিষ রাজার সন্ধানে না বেরোলে এই দুর্গা আমাদের অজানা থেকে যেত।
সুষমা নিজে শাখুয়াপানি গ্রামের মেয়ে। ঝোবিপাটে যেতে যেতে বলছিলেন, দুর্গাপুজো বা নবরাত্রিতে তাঁরা যে অশৌচ পালন করেন, তাকে মহিষাসুর দশা বলে। দীপাবলিকে তাঁরা বলেন সোহরাই, ওই সময় নাভিতে, বুকে ও নাকে করঞ্জী ফুলের তেল লাগান। ‘ওই তিন জায়গাতেই আমাদের পূর্বপুরুষ ত্রিশূলবিদ্ধ হয়েছিলেন, রক্ত ঝরেছিল।’ মাংস বা হাঁড়িয়ার পাশাপাশি সুষমারা ওই সময়ে শশাও খান। শশা নাকি মহিষ রাজাকে খুন করা সেই ছলনাময়ীর হৃদয়ের প্রতীক। গ্রামের লোকেরা গরুর দুধ খায় না, ‘আমরা চাই বাছুরেরা বরং মায়ের দুধ খেয়ে তাগড়াই হয়ে উঠুক, যাতে তাদের জোতের কাজে লাগানো যায়।’
জোত আর কোথায়? গ্রামের বেশির ভাগ লোক এখন বক্সাইটের খাদানে কাজ করেন। এ গ্রামে একটাই প্রাথমিক বিদ্যালয়। নেই কোনও হাসপাতাল। বছর কয়েক আগে সুষমার বাবা অসুস্থ হলে তাঁকে দু’ঘণ্টা দূরে লোহারদাগা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার নেই। আরও দুই ঘণ্টা দূরে গুমলায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই মৃত্যু। অসুরনিধনের গল্প ফুরোয়নি।
গুমলার গুরুত্ব শুধু বড় হাসপাতালে নয়। ঝোবিপাট গ্রামের ললিত অসুর, সুখনা অসুরেরা বলছিলেন তাঁদের অাসুরি উপকথা। সেখানে মহিষাসুর এলাকার রাজা। দেবতাদের সঙ্গে তার বিশেষ বনে না। দেবতারা তাদের বন্ধু দুর্গার শরণাপন্ন হয়। তারা জানত, রূপযৌবন আর ছলাকলায় দুর্গা সবাইকে ভোলাতে পারে। ফলে মহিষ রাজাকে ফাঁদে ফেলা যাক! এক দিন রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে চলেছিল লোহা গলানোর কাজে। সুন্দরী দুর্গা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। কাজ ফেলে মহিষাসুর তার সঙ্গে চলে যায়।
অতঃপর ভেসে যায় আদরের নৌকো। সুন্দরী দুর্গা প্রেমিককে কখনও নিয়ে যায় নদীর ধারে, কখনও বা হাঁড়িয়ার ভাটিখানায়। মহিষাসুরকে তার অস্ত্রগুলিও মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য করে সে। তার পর এক দিন নিরস্ত্র প্রেমিককে মেরে ফেলে। ‘গুমলার টাঙিনাথ পাহাড়ের মাটিতে এখনও বড় বড় অনেক অস্ত্র পোঁতা রয়েছে। অনেক বার মাটি খুঁড়ে ঢাউস তলোয়ার, ত্রিশূল মিলেছে। অসুরবাবাকে ওখানেই মেরে ফেলেছিল’, জানালেন অনিল অসুর।
লোহা গলিয়ে মহিষাসুরের অস্ত্র! প্রত্নতাত্ত্বিকদের একাংশ আজও বলেন, অসুর উপজাতি সাবেক মগধ, পাটলিপুত্রে লোহা গলানোর কাজ করত। সেই বিদ্যায় তারা যে কত দূর এগিয়েছিল, অশোকস্তম্ভগুলিই নাকি তার প্রমাণ। সেই সব লোহায় আজও মরচে পড়েনি। সেই প্রযুক্তিবিদ্যার স্বীকৃতি আজও মিলল না, শুধু জনজাতির ওরাল ট্র্যাডিশনেই রয়ে গেল!
এক এক জনজাতির এক এক উপকথা, ঐতিহ্য। কিন্তু সাঁওতাল, মুণ্ডা, অসুর— প্রতিটি জনজাতিতেই রয়েছে জনপ্রিয় মহিষ রাজা ও ছলনাময়ী এক নারীর উপাখ্যান। মহিষ রাজার মাথায় মোটেই শিং ছিল না, তিনি লোহা গলাতেন, প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। নবরাত্রির সময় আজও সাঁওতালরা তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। যখন পায় না, একটা খড়, মাটির কাঠামো ভেঙে দেয়। সাঁওতালি উৎসবের এই হারিয়ে-যাওয়া রাজা বা ‘হুদুর দুর্গা’-তে আজও মহিষরাজার স্মৃতি অম্লান। মুণ্ডারি উপকথায় আছে, জঙ্গলে এক বুনো মোষ খুঁজে পেল ছোট্ট এক মেয়েকে। তাকে যত্নে বড় করে তুলল সে, মেয়েটি ক্রমে পরমাসুন্দরী যুবতী হয়ে উঠল। রাজা তাকে তুলে নিয়ে যেতে লোক পাঠাল, মোষ তাদের গুঁতিয়ে ছারখার করে দিল। অতঃপর রাজার লোকে মোষকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। মোষ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মারা গেল। রাজা মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেল। মহিষাসুর বধের বিকল্প আখ্যান?
ফিরতি পথে এখন সন্ধ্যার মিঠে হাওয়া। অসুরদের ছেড়ে ফিরতে হবে কলকাতায় দেবতাদের দুনিয়ায়। সবাই জানে, অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে, দেবতারাই জয়ী হয়েছিলেন। দেবীর সেই যুদ্ধজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনা। দেবী সুরাপান করে আরক্তনয়না। হেসে অস্পষ্ট বাক্যে অসুরকে বলছেন, ‘আমি পান করি, তুই গর্জন কর।’ দুর্গা শুধুই সংহারমূর্তি ধারণ করেননি। মদ্যপান, আরক্তলোচন, অস্পষ্ট স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কথার মোহিনী মূর্তিও ছিল।
সেই মোহিনী এক লাফে মহিষাসুরের উপরে চড়ে বসেছিলেন। তার গলায় পা দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন শূল। শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, ধূম্রলোচন— কোনও অসুরকে মারার সময়েই এ ভাবে সুরাপানে দেবীর কথা জড়িয়ে যায়নি। লাফ মেরে কারও শরীরে চড়ে বসেননি।
জনজাতির উপকথায় এই মদ্যপানই হয়ে যেতে পারে হাঁড়িয়া খাওয়া। অসুরের শরীরে চড়ে বসা হয়ে উঠতে পারে প্রেম ও প্যাশনের আততি-ভরা রোমাঞ্চকর এক খুনের মুহূর্ত।
কিন্তু জনজাতি ইতিহাস, পুরাণ রচনা করে না। তারা পরাজিত। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস লেখে। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, সবই বিজয়ীদের ব্যাখ্যা। আসিরিয়ার আসুরবানিপাল কেমন দেখতে ছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা শিলাপটে আজও তা দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে বিজয়ীরা মহিষ রাজার স্মৃতিটুকুও রাখেনি। এক সাঁওতাল শিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখেছিলাম, লাঠি হাতে পাগড়ি মাথায় এক রাজা। কাছে দুটো মোষ চড়ে বেড়াচ্ছে। বিজয়ীর জনসংস্কৃতি এই সব ছবির খবর রাখে না। কুমোরটুলিতে গড়া, ত্রিশূলবিদ্ধ পরাজিত ও রক্তাক্ত পুরুষই তাদের কাছে একমাত্র মহিষাসুর। 
শাখুুয়াপানি গ্রামে চমরু অসুরের কথাটা এখনও কানে বাজছে, ‘এত হইচই কেনে বলেন তো। সবাই জানে, আমরা আলাদা। আগে জমিদার দুগ্গাপুজোর সময় আমাদের জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, পাতা এনে দিতে বলত। আমরা সে সব দিয়ে, পুজো শুরুর আগেই চলে আসতাম। পূর্বপুরুষদের কাছে বলতাম, তাঁরা যেন বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন।’ ঝোবিপাটের অনিল অসুর বলছিলেন, তাঁর মা এক সপ্তমীর সন্ধ্যায় দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিলেন। চার দিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ, অনিলের মায়ের পরনে নতুন শাড়ি। তখনই অনিলের বাবা বলেছিলেন, ‘কোথায় যাও? যে আমাদের পূর্বপুরুষকে মেরে ফেলেছিল, তার পুজো দেখতে?’
অনিলের মা আর যাননি। ছেড়ে ফেলেছিলেন নতুন শাড়ি, বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঘরের দরজা-জানলাও।
অনিলরা অবশ্য এখন দুর্গাপুজোর সময় নিঃশব্দে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেন না। ইন্টারভিউ দেন, সগর্বে জানান তাঁদের রীতিনীতি ও সংস্কারের কথা। হাজার বছর পরে পরাজিতরাও প্রত্যাঘাত করে। জানিয়ে দেয়, বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদই সব নয়। কে বলতে পারে, কুমোরটুলি এক দিন ভিলেন মহিষাসুরের বদলে, মহিষ রাজাকে বেছে নেবে কি না?

কিছু সাক্ষাৎকার ও তথ্য সরবরাহ:
আর্যভট্ট খান, কিশোর সাহা
তথ্যসূত্র : - আনন্দবাজার পত্রিকা