Tuesday, May 29, 2018

কুড়মালি ক্যালেন্ডার -২৭৬৮

ডাউনলোড করুন কুড়মালি ক্যালেন্ডার -২৭৬৮
নিচের লিংক থেকে
👉 https://drive.google.com/file/d/12wa-tY3bQANpE5wFHIRo-_PEutK0XcMJ/view?usp=drivesdk


--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------























Monday, May 28, 2018

মহিষ রাজার আসল ইতিহাস ।


তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে শেষ অবধি ৪২ ডিগ্রি গরমে নেতারহাট পৌঁছতে হল। প্রায় ফার্নেস হয়ে-যাওয়া টিনের কৌটোর মতো লজ্‌ঝড়ে বাস। মানুষ, হাঁসমুরগি ও ছাগলের গাদাগাদি ভিড়। এই বাসটাই আমাদের পৌঁছে দেবে ঝোবিপাট। মহিষ রাজার এলাকায়।
এখানে গ্রামগুলির নাম এ রকমই। ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাট। এই লাল মাটির জঙ্গলে পাট মানে উঁচু জায়গা। বাস রাস্তা থেকে ওই সব গ্রাম ঘণ্টা দুয়েকের হাঁটাপথ।
এই সব পাটেই অনিল অসুর, ললিত অসুর, সুষমা অসুরদের বাস। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে অনেকের ঘরেই আলো জ্বলে না, গায়ে নতুন কাপড় ওঠে না। তাঁদের পূর্বপুরুষ মহিষ রাজাকে দুর্গা নামে বহিরাগত এক সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে অশৌচ পালনের দিন।
ঠিক কী ছিলেন এই মহিষ রাজা? স্বর্গ-মর্ত তছনছ করে দেওয়া এক ভয়ংকর অসুর, যাঁর হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু সব দেবতাকে নিজের শক্তি দিয়ে ডাকতে হল মহামায়াকে? না কি প্রজাপালক এক নৃপতি, যাঁকে নারীর মোহিনী মায়ায় বশ হয়ে শেষ অবধি মৃত্যু বরণ করতে হল? অসুরই বা কারা? দেবতাদের স্বর্গরাজ্য বা মুনিঋষিদের তপোবনে সন্ত্রাসের হানা দেয় যারা?
কিন্তু ঋগ্বেদ তো উলটো কথাই বলছে। মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্র সব বৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সবিতৃ বা সূর্যদেবও ‘সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।’ ঋগ্বেদই জানিয়ে দিল, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়। শক্তিমান এক পুরুষ।
এই ক্ষমতাশালী অসুর-পুরুষ আসলে বিশ্বস্রষ্টা। পার্সি ধর্মের ‘জেন্দ আবেস্তা’র একমাত্র ঈশ্বর: আহুর মজদা। ম্যাক্সমুলার থেকে মনিয়ের উইলিয়াম্স, অনেকেই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, আহুর এবং বৈদিক সংস্কৃতির অসুর অনেকটা এক। খ্রিস্টের জন্মের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ইরাকের কাছে যে আসিরীয় সভ্যতা ছিল, সেখানেও ছিলেন এই আহুর মজদা। আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের এক শিলালিপিতে কিউনিফর্ম সংকেতে রয়েছে ‘আসুর মজদা’র উল্লেখ।
শিলালিপিটা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে আসুরবানিপাল আসিরিয়ার রাজা হয়েছিলেন। শিলাপটে তাঁর সিংহ শিকারের কিছু ছবিও রয়েছে। মহিষ রাজার খোঁজে এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বে সিংহশিকারী এক নৃপতিকে পাওয়া গেল। ভাষাতত্ত্বের খেলায় প্রাচীন আসিরিয়া, অসুর এবং আহুর একদেহে হল লীন।
অসুরেরাও দেবতা। প্রমাণ: রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। সেখানে দেবতা ও অসুর দু’পক্ষই প্রজাপতির পুত্র, বৈমাত্রেয় ভাই। ইন্দ্রের শ্বশুরমশাই পুলোমা এক অসুর। ভক্ত প্রহ্লাদও হিরণ্যকশিপু নামে এক অসুরের পুত্র। কশ্যপ ঋষির ছেলে ময় দানব হয়েও দেবতাদের অলকাপুরী নির্মাণ করে। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদও বানায়। তার বউ এক অপ্সরা, নাম হেমা। দেবাসুরের সংগ্রাম তাই শুধুই যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীসংঘর্ষের কাহিনি নয়। সকলেই আত্মীয়, তাদের মধ্যে বিয়ে-থা’ও হয়।
মহিষ রাজার খোঁজে বেরিয়ে সেই শক্তিমান অসুর পুরুষকে দেখেছিলাম মহীশূরের চামুণ্ডি পাহাড়ে। মহিষাসুর আর তাঁর দুই সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে এই পাহাড়েই বধ করেছিলেন দুর্গা। মহিষাসুর থেকেই কালে কালে অপভ্রংশে মহীশূর নাম। চামুণ্ডি মন্দিরের প্রবেশচত্বরেই বিশাল মূর্তি। গোঁফ ও গালপাট্টাসহ রাজার মতো দাঁড়িয়ে, এক হাতে খড়্গ, আর এক হাতে সাপ। মহিষাসুর মানেই সিংহের আক্রমণে ত্রস্ত, দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ কোনও মহিষরূপী দানব নয়।
খুঁজতে খুঁজতে মহিষ রাজার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের পাওয়া গেল এই বাংলায়। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানে। বাগানের শেষ প্রান্তের কারি লাইনে রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা খুড়ো অসুর জানালেন, ‘দুর্গাপুজোয় আমরা যোগ দিই না, কারণ সেখানে মহিষাসুরকে হত্যা করা হয়েছিল। সে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল।’
এই অসুরেরা সকলেই ঝুপড়িতে থাকেন। মহিলারা বাগানে চা-পাতা তোলেন, পুরুষেরা বেশির ভাগ সময় দিনমজুরের কাজে ভুটান চলে যান। সেখানে দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরি। কেউ আবার ভুটান থেকে আসা বস্তায় বাঁধা কাঁচা সুপারি গাড়িতে তোলার কাজ করেন। মেটেলি আর মালবাজারের চা-বাগানে আরও কয়েক ঘর অসুর আছেন। সেখানেই ওঁরা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতান।
কিন্তু ধর্ম? ১৮৮০ সালে ক্যারন চা-বাগানের পত্তন। সেই সময় রাঁচি ও ছোটনাগপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুলির কাজে নিয়ে আসা হয় ওঁদের। আগে জঙ্গলে শিকারও করতেন, নিজেদের হিন্দু এবং শিবের উপাসক বলে পরিচয় দিতেন। মহিষাসুরের উত্তরাধিকারী আদিবাসী অসুর এবং শিবপুজো করা কিরাতদের একাকার হওয়াতেই ভারতীয় ঐতিহ্য।
বাগানের ১০১টি অসুর-ঘরের মধ্যে ৯০টিই আজ খ্রিস্টান। ৮০ বছরের বর্গী অসুরের ছেলে ও নাতিরা যেমন! ‘আমি নতুন জীবনে গিয়ে হয়তো মানাতে পারব না। ছেলেপুলেরা বাগানে পাতা তোলে, আমিও আজীবন ওই কাজটাই করেছি। নতুন ধর্ম যদি ওদের একটু ভাল রাখে!’

বাগানের শেড ট্রিতে বসে বর্গী বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় দুর্গাপুজোটা খুব খারাপ লাগত। চার দিকে হইচই, কিন্তু মা আমাদের ঘরের বাইরে বেরোতে দিত না। বলত, বেরোলেই অলুক্ষুণে কিছু ঘটবে। পরে দেখলাম, বন্ধুবান্ধবরাও আমার পদবি নিয়ে ঠাট্টা করে। এখন আমরা আর কিছু লুকোই না। বছরে দু’বার, ফাল্গুন মাসে আর দশেরায় আমরা অসুরবাবার পুজো করি।’ বর্গীর পাশের বাড়ির তরুণী ললিতা অসুর শুনতে শুনতে পালটা ঝাঁজি মেরে উঠল, ‘আ মোলো! আমি মহিষাসুরের বংশধর হতে যাব কেন? দাদু, আমাদের এখানে তো অনেকে টোপো, কাজুর এ সব পদবিও নিয়েছে গো!’
মহল্লার একমাত্র অনসুর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জগন্নাথ মাহাতো। সবাই ডাকে মাস্টারজি বলে। তাঁর আক্ষেপ, ‘ওরা আজকাল অনেক বদলে গিয়েছে। আগে শিকার করে অনেক মাংসই খেত, এখন রান্নার ধরনধারনও তেল-হলুদ-সর্ষেবাটা দিয়ে আমাদের মতোই।’
শুধুই রন্ধন এবং ধর্মসংস্কৃতি নয়। একশো-দেড়শো বছর ধরে বিভিন্ন চা-বাগান ও খাদানের কুলি লাইনে হতদরিদ্র অভিবাসী হতে হতে অসুরেরা হারিয়েছেন নিজস্ব ভাষা। ১৮৭২ সালের জনগণনায় ১৮টি জনজাতির কথা বলা হয়। সবচেয়ে বেশি লোক ছিলেন অসুরদের মধ্যে। ১৭৪ বছর পর সেই অসুরেরা আজ ঝাড়খণ্ডের এক ‘আদিম জনজাতি’— প্রিমিটিভ ট্রাইব। তাঁদের বেশির ভাগ সময় মুণ্ডাদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, অাসুরি ভাষাকে মুণ্ডারি উপভাষার মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তিন বছর আগেও গণেশ দাভি-র ‘পিপ্‌লস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, অাসুরি সহ ভারতের প্রায় দেড়শোটি ভাষা ধবংসের মুখে। মহিষ রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ট্র্যাজেডি ক্রমে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবহেলায় কী ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে জনজাতিদের নিজস্ব ভাষা, গান, উপকথার মৌখিক সংস্কৃতি।
পশ্চিমবঙ্গও এ ব্যাপারে সমান দায়ী। গত বছর কোজাগরী পূর্ণিমায় পুরুলিয়ায় চরণ মাহাতো, সুষেণজিৎ বৈরাগীরা ‘মহিষাসুর দিবস’ পালন করছিলেন।  পুরুলিয়ায় সুষেণজিতের পুজো মণ্ডপে এসে স্থানীয় পুলিশ অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে। সুষেণের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘প্রিয়জন মারা গেলে আজকাল পুলিশের থেকে অশৌচেরও অনুমতি নিতে হয়?’ পুলিশ কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। সিধু-কানুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করলেই হয় না, আদিবাসীদের বিপন্ন সংস্কৃতির কথাও বুঝতে হয়।
সেই সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছিলেন রাঁচির সমাজকর্মী, ‘ঝাড়খণ্ডী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আখড়া’র বন্দনা টেট, ‘শুধু অসুর নয়, সাঁওতাল এবং পোকরুদের উপকথাতেও আপনি মহিষ রাজা এবং দুর্গা তাকে কী ভাবে মোহিনী রূপে ভুলিয়েভালিয়ে বধ করলেন, সেই গল্প পাবেন।’ এই আখড়া বা পরিষদের তরুণী সুষমা অসুরই অাসুরি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত কবি। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল্যাংগোয়েজ ফেস্টিভ্যালে তাঁর কবিতার বই ‘অসুর সিরিং’ নিয়ে গিয়েছিলেন: ‘খেতো মে যব হুল চলাওগে/ তব ধান বোয়েগে/ নহি তো ঘাস আ জায়েগা।’ রাঁচি, নেতারহাটের মালভূমিতে রোজকার হতদরিদ্র জীবন নিয়ে একটি মেয়ের কবিতা। সুষমারা সম্প্রতি ফেসবুকে ‘অসুর আদিবাসী ডকুমেন্টেশন ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি ওয়েব পেজও খুলেছেন। মহিষ রাজার উত্তরপ্রজন্মে ক্লাস টুয়েল্ভ পাশ এক মেয়ে কবিতা লিখে, সংগঠন তৈরি করে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একুশ শতকের দশভুজা। নেতারহাটের রোদ-জ্বলা টাঁড়ভূমিতে মহিষ রাজার সন্ধানে না বেরোলে এই দুর্গা আমাদের অজানা থেকে যেত।
সুষমা নিজে শাখুয়াপানি গ্রামের মেয়ে। ঝোবিপাটে যেতে যেতে বলছিলেন, দুর্গাপুজো বা নবরাত্রিতে তাঁরা যে অশৌচ পালন করেন, তাকে মহিষাসুর দশা বলে। দীপাবলিকে তাঁরা বলেন সোহরাই, ওই সময় নাভিতে, বুকে ও নাকে করঞ্জী ফুলের তেল লাগান। ‘ওই তিন জায়গাতেই আমাদের পূর্বপুরুষ ত্রিশূলবিদ্ধ হয়েছিলেন, রক্ত ঝরেছিল।’ মাংস বা হাঁড়িয়ার পাশাপাশি সুষমারা ওই সময়ে শশাও খান। শশা নাকি মহিষ রাজাকে খুন করা সেই ছলনাময়ীর হৃদয়ের প্রতীক। গ্রামের লোকেরা গরুর দুধ খায় না, ‘আমরা চাই বাছুরেরা বরং মায়ের দুধ খেয়ে তাগড়াই হয়ে উঠুক, যাতে তাদের জোতের কাজে লাগানো যায়।’
জোত আর কোথায়? গ্রামের বেশির ভাগ লোক এখন বক্সাইটের খাদানে কাজ করেন। এ গ্রামে একটাই প্রাথমিক বিদ্যালয়। নেই কোনও হাসপাতাল। বছর কয়েক আগে সুষমার বাবা অসুস্থ হলে তাঁকে দু’ঘণ্টা দূরে লোহারদাগা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার নেই। আরও দুই ঘণ্টা দূরে গুমলায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই মৃত্যু। অসুরনিধনের গল্প ফুরোয়নি।
গুমলার গুরুত্ব শুধু বড় হাসপাতালে নয়। ঝোবিপাট গ্রামের ললিত অসুর, সুখনা অসুরেরা বলছিলেন তাঁদের অাসুরি উপকথা। সেখানে মহিষাসুর এলাকার রাজা। দেবতাদের সঙ্গে তার বিশেষ বনে না। দেবতারা তাদের বন্ধু দুর্গার শরণাপন্ন হয়। তারা জানত, রূপযৌবন আর ছলাকলায় দুর্গা সবাইকে ভোলাতে পারে। ফলে মহিষ রাজাকে ফাঁদে ফেলা যাক! এক দিন রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে চলেছিল লোহা গলানোর কাজে। সুন্দরী দুর্গা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। কাজ ফেলে মহিষাসুর তার সঙ্গে চলে যায়।
অতঃপর ভেসে যায় আদরের নৌকো। সুন্দরী দুর্গা প্রেমিককে কখনও নিয়ে যায় নদীর ধারে, কখনও বা হাঁড়িয়ার ভাটিখানায়। মহিষাসুরকে তার অস্ত্রগুলিও মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য করে সে। তার পর এক দিন নিরস্ত্র প্রেমিককে মেরে ফেলে। ‘গুমলার টাঙিনাথ পাহাড়ের মাটিতে এখনও বড় বড় অনেক অস্ত্র পোঁতা রয়েছে। অনেক বার মাটি খুঁড়ে ঢাউস তলোয়ার, ত্রিশূল মিলেছে। অসুরবাবাকে ওখানেই মেরে ফেলেছিল’, জানালেন অনিল অসুর।
লোহা গলিয়ে মহিষাসুরের অস্ত্র! প্রত্নতাত্ত্বিকদের একাংশ আজও বলেন, অসুর উপজাতি সাবেক মগধ, পাটলিপুত্রে লোহা গলানোর কাজ করত। সেই বিদ্যায় তারা যে কত দূর এগিয়েছিল, অশোকস্তম্ভগুলিই নাকি তার প্রমাণ। সেই সব লোহায় আজও মরচে পড়েনি। সেই প্রযুক্তিবিদ্যার স্বীকৃতি আজও মিলল না, শুধু জনজাতির ওরাল ট্র্যাডিশনেই রয়ে গেল!
এক এক জনজাতির এক এক উপকথা, ঐতিহ্য। কিন্তু সাঁওতাল, মুণ্ডা, অসুর— প্রতিটি জনজাতিতেই রয়েছে জনপ্রিয় মহিষ রাজা ও ছলনাময়ী এক নারীর উপাখ্যান। মহিষ রাজার মাথায় মোটেই শিং ছিল না, তিনি লোহা গলাতেন, প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। নবরাত্রির সময় আজও সাঁওতালরা তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। যখন পায় না, একটা খড়, মাটির কাঠামো ভেঙে দেয়। সাঁওতালি উৎসবের এই হারিয়ে-যাওয়া রাজা বা ‘হুদুর দুর্গা’-তে আজও মহিষরাজার স্মৃতি অম্লান। মুণ্ডারি উপকথায় আছে, জঙ্গলে এক বুনো মোষ খুঁজে পেল ছোট্ট এক মেয়েকে। তাকে যত্নে বড় করে তুলল সে, মেয়েটি ক্রমে পরমাসুন্দরী যুবতী হয়ে উঠল। রাজা তাকে তুলে নিয়ে যেতে লোক পাঠাল, মোষ তাদের গুঁতিয়ে ছারখার করে দিল। অতঃপর রাজার লোকে মোষকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। মোষ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মারা গেল। রাজা মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেল। মহিষাসুর বধের বিকল্প আখ্যান?
ফিরতি পথে এখন সন্ধ্যার মিঠে হাওয়া। অসুরদের ছেড়ে ফিরতে হবে কলকাতায় দেবতাদের দুনিয়ায়। সবাই জানে, অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে, দেবতারাই জয়ী হয়েছিলেন। দেবীর সেই যুদ্ধজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনা। দেবী সুরাপান করে আরক্তনয়না। হেসে অস্পষ্ট বাক্যে অসুরকে বলছেন, ‘আমি পান করি, তুই গর্জন কর।’ দুর্গা শুধুই সংহারমূর্তি ধারণ করেননি। মদ্যপান, আরক্তলোচন, অস্পষ্ট স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কথার মোহিনী মূর্তিও ছিল।
সেই মোহিনী এক লাফে মহিষাসুরের উপরে চড়ে বসেছিলেন। তার গলায় পা দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন শূল। শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, ধূম্রলোচন— কোনও অসুরকে মারার সময়েই এ ভাবে সুরাপানে দেবীর কথা জড়িয়ে যায়নি। লাফ মেরে কারও শরীরে চড়ে বসেননি।
জনজাতির উপকথায় এই মদ্যপানই হয়ে যেতে পারে হাঁড়িয়া খাওয়া। অসুরের শরীরে চড়ে বসা হয়ে উঠতে পারে প্রেম ও প্যাশনের আততি-ভরা রোমাঞ্চকর এক খুনের মুহূর্ত।
কিন্তু জনজাতি ইতিহাস, পুরাণ রচনা করে না। তারা পরাজিত। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস লেখে। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, সবই বিজয়ীদের ব্যাখ্যা। আসিরিয়ার আসুরবানিপাল কেমন দেখতে ছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা শিলাপটে আজও তা দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে বিজয়ীরা মহিষ রাজার স্মৃতিটুকুও রাখেনি। এক সাঁওতাল শিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখেছিলাম, লাঠি হাতে পাগড়ি মাথায় এক রাজা। কাছে দুটো মোষ চড়ে বেড়াচ্ছে। বিজয়ীর জনসংস্কৃতি এই সব ছবির খবর রাখে না। কুমোরটুলিতে গড়া, ত্রিশূলবিদ্ধ পরাজিত ও রক্তাক্ত পুরুষই তাদের কাছে একমাত্র মহিষাসুর। 
শাখুুয়াপানি গ্রামে চমরু অসুরের কথাটা এখনও কানে বাজছে, ‘এত হইচই কেনে বলেন তো। সবাই জানে, আমরা আলাদা। আগে জমিদার দুগ্গাপুজোর সময় আমাদের জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, পাতা এনে দিতে বলত। আমরা সে সব দিয়ে, পুজো শুরুর আগেই চলে আসতাম। পূর্বপুরুষদের কাছে বলতাম, তাঁরা যেন বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন।’ ঝোবিপাটের অনিল অসুর বলছিলেন, তাঁর মা এক সপ্তমীর সন্ধ্যায় দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিলেন। চার দিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ, অনিলের মায়ের পরনে নতুন শাড়ি। তখনই অনিলের বাবা বলেছিলেন, ‘কোথায় যাও? যে আমাদের পূর্বপুরুষকে মেরে ফেলেছিল, তার পুজো দেখতে?’
অনিলের মা আর যাননি। ছেড়ে ফেলেছিলেন নতুন শাড়ি, বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঘরের দরজা-জানলাও।
অনিলরা অবশ্য এখন দুর্গাপুজোর সময় নিঃশব্দে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেন না। ইন্টারভিউ দেন, সগর্বে জানান তাঁদের রীতিনীতি ও সংস্কারের কথা। হাজার বছর পরে পরাজিতরাও প্রত্যাঘাত করে। জানিয়ে দেয়, বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদই সব নয়। কে বলতে পারে, কুমোরটুলি এক দিন ভিলেন মহিষাসুরের বদলে, মহিষ রাজাকে বেছে নেবে কি না?

কিছু সাক্ষাৎকার ও তথ্য সরবরাহ:
আর্যভট্ট খান, কিশোর সাহা
তথ্যসূত্র : - আনন্দবাজার পত্রিকা

Sunday, May 27, 2018

"রহইন পরব"।

"রহইন পরব"।

আদিকাল  থেকে চলে আসছে আদিবাসীদের মধ্যে রহইন পরব।এই দিনটি আদিবসীদের মধ্যে একটি পরব।প্রতিবছর এই পূজা জ্যোষ্ঠি মাসের 13 দিনে পালিত হয়।এই পরবটি চাষ-বাসকে কেন্দ্র করে পালিত হয়।আদিবাসীরা চাষ-বাস আরম্ভ করার আগে এই দিনটিতে পিঠে,মাংস সবার সাথে খেয়ে আনন্দ ফুর্তি করে পরের দিন থেকে চাষ-বাসের কাজে নেমে যায়।
এই  সময় অনেক বিষাক্ত সর্পকুলের জন্ম হয় এবং মাটির নীচে থাকা বিষাক্ত জীব জন্তু বাইরে বার হতে শুরু করে ।তাদের হাত থেকে বাঁচার/রেহাই পাওযার জন্য আষাড়ী ফল বা রহইন ফল খাওয়া হয়।
আজকের দিনে সকাল বেলার সময় ধোয়ার পর/লিপা লরার পর রহইন পুজা করা হয়।পূজা শেষ হওযার পর ঘরের কেউ এক জন নতুন ধুতি-গেঙ্জি পরে ওনতুন টুঁকিতে করে ধান নিযে ধান খেতে যায়।ধান খেতে নিযে যাওয়ার পর জল,মাটি দিযে বোনে।এটা কেউ সকাল ,কেউ বিকালে করে।আর মেয়েরা ঘরের সকল টুঁকি,খাঁচি ,পযলা-সের,ঘরের দুয়ারে,ডেলি ইত্যাদিতে চালের গুঁড়ি ও সিঁন্দুর দেয়।সন্ধ্যার সময় কুমারী মেয়েরা রহইন মাটি আনে।এই মাটি এনে প্রথমে তুলসী মঞ্চে রাখা হয়।পরের দিন ভোর বেলায রহইন মাটি ঘরের তীন কুনে রাখা হয়।ঘরের মধ্যে থাকা বিষাক্ত জীব জন্তু যে কোনাতে মাটি দেওযা হয নি সেই কোনা দিযে রীতি প্রচলিত।।
                 বিনীত
             সাগর মাহাত 
বড়াম ,আড়শা , পুরুলিয়া।।

Monday, May 14, 2018

প্রহসণ ও প্রচ্ছন্ন অন্ধকারের অবসান হোক

                   গত দু-তিন বছরে ভারতের বিস্তীর্ণ মালভূমি এলাকা ছোটনাগপুর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে। ছোটনাগপুর বলতে আমরা যা বুঝি- " শিখ্-শিখর নাগপুর/আধাআধি খড়গপুর"। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, পশ্চিম-দক্ষিণ বাঁকুড়া( বর্তমান খাতড়া), পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম সহ ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশ্যার বিস্তীর্ণ এলাকা এই মালভূমির অন্তর্গত। এই মালভূমি এলাকায় সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় বসবাস আদিবাসী জনজাতির। কিন্তু ঘটনা হলো, এই আদিম তপশীলির কিছু গোষ্ঠী যথা, সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমীজ, ইত্যাদি উপজাতি সংবিধান স্বীকৃত তপশীলি উপজাতি, এবং কিছু গোষ্ঠী প্রধানত কুড়মী সম্প্রদায় স্বাধীনতার পর থেকেই আদিবাসী স্বীকৃতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ব্রতী। 
        প্রথমেই লেখার স্বচ্ছতা প্রমাণে এই কুড়মী সম্প্রদায় যে আদিবাসী তথা তপশীলি উপজাতি, তার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ রাখি। 
ঘটনাচক্রে চলে যেতে হয় Indian Succesion Act, 1865( X of 1865) এর কথায়, যে Act র 332 নং ধারায় Governer General পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছে, মুণ্ডা, ওরাঁও, সাঁওতাল, হো, ভূমীজ, ঘাসী, গোণ্ড, কান্ধ, কোড়া, কুড়মী, মেল সারিয়ান ও পান আদিম অধিবাসী, এই অধিবাসীদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হলো। 
       পরবর্তী 1913 সালের 2 রা May, সীমলাতে এক বৈঠক হয়। এবং পরদিন 3 রা May প্রকাশিত হয় " The Gazette of India. তার 550 নং নোটিফিকেশনে পরিস্কার ভাবে উল্লেখিত রয়েছে 1865 র Indian Suceesion Act এ নিবন্ধিত জনসম্প্রদায় হলো উপজাতি। 
         আরো কিছু সংগৃহীত প্রমাণ রাখি-- 
      1. 1918-1925 সালে, Survey and Settlement Portion, Manbhum District by B.K.Gokhle, I.C.S, Settlement of ficer of Chhotonagpur এ Chapter 1 এর 22 নং পয়েন্টে( পাতা নং 14) ঘোষণা করেছিলেন- " The following castes are S.T such as Kurmi, Santal, Bauri, Bhumij, Bhunia, Kora, Kheria, Oran, Munda and Ho. 
     2. 1925 সালে পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসন একটি মামলার রায়ে মন্তব্য করেন- " The Kurmi Mahato of Manbhum district are racially an aboriginal tribe". এই পাটনা হাইকোর্টেরই AIR, 1931, page.no 305 এ গণেশ মাহাত বনাম শিবচরণ মাহাতোর মামলার রায় দানকালে বিচারপতি জাওলাপ্রসাদ ও বিচারপতি কনবন্ত সাহানী মন্তব্য করেন," বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষই " aborginal tribe". 
      3. এছাড়াও বিহার ও উড়িষ্যা গেজেটের (Notification no 49, Patna, wednesday, 16 th dec, 1939) এবং Judicial department( noti-8th dec, 1939) অনুসারে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও সহ কুড়মী সম্প্রদায়ও তপশীলি উপজাতিভুক্ত। 
        প্রশ্ন হলো, তাহলে কুড়মী সম্প্রদায় আদিবাসী তপশীলি উপজাতি স্বীকৃতি হারালো কি করে??? --- এর উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর ষড়যণ্ত্র ও প্রহসন। চলে যেতে হয় অধুনা ইতিহাসে। 1918 সালে যখন " সাউথ বরো কমিশন" ভারতে আসে, তখন বাবা সাহেব আম্বেদকর সেই কমিশনকে ভারতীয় তপশীলি জাতি ও উপজাতিদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনেতিক সহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের জন্য লিখিত এক মেমোরেন্ডাম দেন।   
                     এরপর 1919 সালে First Indian Act রচিত হয়, এবং তপশীলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য মনোনয়নের অধিকার দেওয়া হয়। ঠিক এখানেই শুরু হলো সমস্যা। সংখ্যার আধিক্যে অধিকাংশ মনোনয়নের অধিকার চলে যায় আদিবাসী ও তপশীলি সম্প্রদায়ের কক্ষে। আর এখানেই শুরু হয় সেই ব্রাহ্মণ্যবাদের খেলা, শুরু হয় দলভারী করার কাজ, শুরু হয় গৈরীকরণ। 1925 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় সয়ং সেবক সংঘ, যারা এই কাজকে আরো তরাণ্বীত করে। ভারতীয় আদিবাসীদের গলিতে গলিতে মন্দির গড়ে ওঠে, ঘরের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারা। 
        এরপর 1930-31 সালে Round Table Conferance এ প্রধাণ চারটি দাবী ওঠে। Separate Electors, Dwell voting, Adult Frqnchies and Adequate Representation according to population. 
     সবকিছু ঠিক থাকলেও বাধ সাধে এই চার নং দাবী নিয়ে। ততকালীন ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হল আদিবাসী, আর এই ছোটনাগপুরে প্রায় শতকরা শতভাগই হলো আদিবাসী সম্প্রদায়। আর এদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য হলো কুড়মী সম্প্রদায়। তার জন্য প্রজাসত্ত্ব আইনকে লঘু করতে শুরু হয় এক ঘৃণ্য চক্রান্ত, "ছোটনাগপুর ভাঙন"। বর্তমানে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশ্যা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এরকম ভাঙতে ভাঙতে ছোট ছোট জেলাতে এসে ঠেকেছে, সেই জেলাও রেহাই পায় নি, মেদিনীপুর কে ভেঙে পূর্ব-পশ্চিম এবং এখন ঝাড়গ্রাম তারই ভগ্নাংশের দেহাবশেষ। 
       পরবর্তীকালে 1950 সালে সংবিধান রচনার সময় সাংবিধানিক ভাবে আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে গিয়ে অজানা এক কারণে এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কুড়মীদের বাদ দিয়ে রচিত হয় সংবিধান। প্রসঙ্গত CNT act এর section 1 এর subsection 1 এ বলা হয় সংখ্যাগরীষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রয়োজনানুসারে কমিটি গঠন করে আইন প্রণয়ন করতে পারবে, এছাড়া কলকাতা হাইকোর্টের Deputy Commissioner Roy Bahadur এর লিখিততে স্পষ্টভাবে বলা হয়, Hill Area তে কোন রাজনৈতিক দলেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা থাকবে District Counsillor র হাতে। এই দুটো জিনিসকে ধামাচাপা দিতেই এবং সমগ্র জঙ্গলমহলের জল-জমি-জঙ্গল তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে কুড়মী সম্প্রদায় তথা আদিবাসীদের সাথে এই চক্রান্ত রচিত হয়। 
      এরপর থেকেই শুরু হয় কুড়মী সম্প্রদায়ের আদিবাসী তপশীলি উপজাতি তালিকায় পুনর্ভূক্তির আন্দোলন। আন্দোলনের ফুলকি ধিকি ধিকি জ্বললেও প্রথম তা আগ্নেভ রুপ নেয় 1955-56 সালে। বিষ্ণুচরণ মাহাতো ও ক্ষুদিরাম মাহাতোর নেতৃত্বে "ছোটনাগপুর কুড়মী পঞ্চ" নামে এক সংগঠন থেকে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রথম মেমোরেন্ডাম দেওয়া হয়। ঠিক এই সময় সংগঠনকে দুর্বল করতে ও দাবীর বিরোধিতায় কুড়মীদের সাথে খেলা হয় আরো এক ঘৃণ্য রাজনীতি। পুরুলিয়ার কিয়দংশ এবং সমগ্র বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের কুড়মীদের ভাষাতে কিছুটা বাংলা চল থাকায়, ব্রাহ্মণ্যবাদী কিছু সংগঠনকে দিয়ে দাবী তোলা করানো হয়, বঙ্গভুক্তিতে। এই সময় সাংবিধানিক জ্ঞান ও শিক্ষা হতে সমাজ বহু দূরে থাকায় এই ছলনা বা ঘৃণ্য কৌশলটা বুঝতে পারে নি। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতোই, ভাষার অজুহাতে বঙ্গভুক্তি ঘটলেও প্রাণ থেকে যায় সেই সাধের ছোটনাগপুরেই। 
        সংবিধান রচনার সময়তে কুড়মীদের আদিবাসী তপশীলি উপজাতি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কোন কারণ দেখাতে না পারায়, পরবর্তী কালেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কুড়মী সম্প্রদায় উপজাতি হিসেবেই বিবেচিত হতো। যেমন, 
1957 সালে পুরুলিয়ার মানবাজার বিধানসভার বিধায়ক সত্যকিঙ্কর মাহাতো যুগ্ম আসনে তপশীলি উপজাতির সংরক্ষিত আসন থেকেই বিধায়ক হন। 
এরপরো 1986 সালের 8 ই July, কোলকাতা হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি N.K.Mitra মহাশয়, তার এক রায়ে বলেছেন, "গনেশ মাহাতো, ললিতমোহন মাহাতো, পিতা দর্পনারায়ণ মাহাতো, গ্রাম+পোষ্ট-জোরোবাড়ি, থানা-মানবাজার, জেলা-পুরুলিয়া বনাম বিপিণ মাঝি, পিতা লপসা মাঝি, উভয়পক্ষই আদিবাসী তপশীলি উপজাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। 

       প্রশ্ন হতেই পারে, তাহলে এতই যদি প্রমাণ থেকে থাকে আদিবাসীর স্বপক্ষে, তাহলে আজ অন্তর্ভুক্তির জন্য এতো আন্দোলন করতে হচ্ছে কেন???? 
---- উত্তরটাও খুব সোজা, তবু বলি, আমি, তুমি, জগাই, মাধাই, সংবিধানের 5th schedule( এটা অন্যদিন আলোচনা করবো)- র কথাটা না জানলেও, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার তথা আমলারা ভালোভাবেই জানে। ঠিক এইজন্যই, 1950 র পরে প্রায় 27 টি বিভিন্ন রাজ্যের জনগোষ্ঠিকে সহজেই আদিবাসী তালিকায় জায়গা দিলেও ছোটনাগপুর এলাকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে রাখার জন্যই শুরু হয় যতসব টালবাহানা। পরে 2000 সালে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ততদিনে আগেই বলেছি, 1925 থেকেই শুরু হয়েছে সারা ভারতে গৈরীকরণ। ততদিনে কুড়মী সম্প্রদায়ো বাদ যায়নি, হয়তো এমনো দেখা যেতো যে, ব্রাহ্মণরা যতটা না দেব দেবী তথা হিন্দু আচার রীতি পালন করে, তার চাইতে বেশী করে ভাবের ঘোরে চুরি হয়ে যাওয়া কিছু কুড়মী পরিবার। এবং ততকালীন সময়ে বাজপেয়ীর কেন্দ্রীয় সরকার খুব ভালো জানতো এই ব্যাপারটা, তাই 2002 সালে আদিবাসী তালিকায় অন্তর্ভূক্তির জন্য সংসদে বিল পাশ করে এক নতুন নিয়মের আমদানী করে। 
       এখানে আদিবাসী তালিকায় পুনর্ভূক্তির জন্য পাঁচটি criteria র কথা বলা হয়। যথা, 1. Indications of primitive, 2. Distinctive Culture 3. Geographical Isolation, 4. Shyness of contact with the community in large number, 5. Backwardness, এবার আসি এগুলোর বিশ্লেষণে । 
          প্রথম হলো, Indications of Tribe: এ ব্যাপারে একটা রিপোর্টেই যথেষ্ট, যেটা হলো census report. Census report অনুযায়ী, 1901 to 1911- Aborginal Tribe community, 1913 সালে 550 নং notification অনুসারে, Primitive tribe, 1921- Animist, 1931-Primitive tribe, 1941- Tribal Community. তাছাড়া সবথেকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমান হলো, The History and Geography of Human Genes, L. Luca Cavalli- S Forza, Paolo Menozzi and Alberto Piazza, Princeton University দ্বারা কৃত DNA test এ কুড়মী সম্প্রদায় মুন্ডা, ভূমিজ, বীরহড় সহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাথেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত। তাহলে কি দাঁড়ালো, প্রথম criteria তে পাশ। 

         দ্বিতীয় হলো, Distinctive Culture: কুড়মীদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠান বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত এবং অদ্বিতীয় ও স্বতন্ত্র। সনাতন ধর্মেরো আগে হতে এই সংস্কৃতি চলমান। বাগুত, কুদরা, গরাম, ঠাকুরমাই, জিহুড়, করম, যাওয়া, বুঢ়াবাবার পূজা সহ বিয়ে, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন, পাতাপূজা, ধরমপূজা, সবেতেই নিজস্বতা বিদ্যমান। এই cruteria তেও পাশ। 

       তৃতীয় হলো, Geographical isolotion: প্রথমেই বলি, ছোটনাগপুর এলাকা অর্থাৎ "শিখ্-শিখর নাগপুর/ আধা-আধি খড়গপুর"- এই এলাকাতে এখনো কুড়মী সম্প্রদায়ের বাস আধিক্য, ছোটনাগপুর মালভূমিতে মাথা রেখেই আজো এই সম্প্রদায় কৃষিকাজ ও পশুপালন করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়াও ততকালীন ব্রিটিশ আমলে, অসমের চা বাগানে এর শ্রমিক যোগানেও অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে সাথে এই কুড়মী সম্প্রদায়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই সূত্রে আসামেও জনসম্প্রদায়ের আধিক্য দেখা যায়। অর্থাৎ কি দাঁড়ালো , এই criteria তে পাশ। 

        চতুর্থ হলো, Shyness of contact with the community in large: এটাতো বুঝতেই পারছেন, অবশ্যই, কুড়মী সমাজের নিজস্ব কুড়মালী ভাষা আছে ভাব বিনিময়ের জন্য। এবং বিশ্বাস করা হয় যে, এই ভাষা এক স্বতন্ত্র দ্রাবীড় ভাষাগোষ্ঠী এবং এই ভাষা থেকেই কিছু কিছু ভাষার উদ্ভব ঘটেছে, যেমন, উড়িয়া, ঝাড়খণ্ডী, মানভুঁই ইত্যাদি। কাজেই এই criteria তেও পাশ। 

       এবার পঞ্চম তথা সর্বশেষ, এটি হলো Backwardness: এটা আর কি বলবো, কুড়মী সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন দেখলেই বুঝতে পারা যায়, এখনো অধিকাংশ মানুষ দিনে আনে দিন খায়, চাষবাস ও কৃষিকাজের ওপশ শতকরা 97 ভাগ মানুষ নির্ভরশীল। শিক্ষায় পিছিয়ে, পেশাতে পিছিয়ে, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে, কতজন লোক চাকরী করেন?? হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। সর্বোপরী backwardness আছে বলেই তো এই সম্প্রদায় এখন অন্যান্য অনগ্রসর তালিকাভুক্ত। কাজেই এটা মনে হয় না আর লিখতে হবে। অর্থাত এই পাঁচটা criteria তেই পাশ। অর্থাত বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই হোক আর যুক্তিসঙ্গত ভাবেই হোক, এক জোরালো দাবী রাখে এই সম্প্রদায়কে আদিবাসী তালিকায় পুনর্ভুক্তির। 

        কিন্তু ঘটনা হলো, স্বপক্ষে এতো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যৌথ সরকারের টালবাহানায় আজো অন্তর্ভুক্তি হয় নি, আর এই জন্য কুড়মী সম্প্রদায় আদিবাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য, ডুঁড়কুতে প্রায় 50 লক্ষ্যাধিক কুড়মী সম্প্রদায়ের মানুষ জমায়েত হয়। কিন্তু, এখানেও সেই মতাদর্শের ভিন্নতার জন্য পরবর্তীকালে আবার সংগঠিত হয়, এবং 6 ই ফেব্রুয়ারী, 2017 তে এই কুড়মী সম্প্রদায় এক সাথে চার রাজ্যে "রেল রোকো" কর্মসূচীতে মানুষ প্রমাণ করে দেয়, নিজের জাতিস্বত্তা পুনরুদ্ধারে কতটা উদ্গ্রীব। তার ঠিক আট মাসের মাথায় 20 ই সেপ্টেম্বর "ডহর ছেঁকা" নামক এক কর্মসৃচীতে বুঝিয়ে দেয় জাতিস্বত্তার আন্দোলনের জন্য তারা প্রাণ দিতেও রাজী। এর পরেই রাজ্য সরকার সদর্থক ভূমিকা নেয়। কিন্তু সেই ভূমিকা যথার্থ ছিল না,, তাই আবার 6 ই মার্চ, 2018, " জিগিড়জিটা গবচন" নামে এক কর্মসূচীতে জেলাশাসকের দপ্তরে অবস্থান প্রমাণ করে 80 বছরের বঞ্চনার যেনো হিসাব কড়াই গণ্ডাই বুঝে নিতে চাই এ সমাজ।   এবং এই মুহূর্তে যতটা তত্পরতা দেখিয়েছে যৌথ সরকার তা আন্দোলনেরই ফল। এবং এই বঞ্চণা ও প্রহসন থেকে মুক্তি পেতে একি সাথে চার রাজ্য যথা পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখিত অংশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশ্যা ও আসাম, একি সাথে আগামী  আগস্টে "দিল্লী চলো"-র ডাক দেয়, এবং প্রত্যেকেই বদ্ধপরিকর এই কর্মসূচীতেই বঞ্চনা, প্রহসনের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন ভোর দখতে।  তাই, অনুরোধ কোন এক সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক তথা মৌলিক অধিকার প্রদানে রাজনৈতিক চাপানউতোর অবিলম্বে বন্ধ হোক। এবং  এতদিন ধরে যে কুড়মী সম্প্রদায়ের সাথে প্রহসনের খেলার সাথে সাথে এক প্রচ্ছন্ন অন্ধকারে রেখে জল-জমি- জঙ্গল আত্মসাৎ করা হচ্ছে, তারো অবসান হোক।


লেখা-সুজিত কুমার মাহাতো