Sunday, March 25, 2018

“সারহুল/সারুল- এক প্রকৃতি বরনের বর্ননা”


লেখা ~ মৃন্ময় বঁসরিয়ার

লালমাটির মহুল-মাতাল গন্ধে মাতোয়ারা শাল-পিয়াল-সোনাঝুরির সবুজ রাজত্বের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে শিমূল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ায় রং-এর মাতামাতি দেখে মনে হয় বনে বনে আগুন লেগেছে।  গানের কলি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠলো — 

     ‘ফুটলঅ সারইও ফুল/ নানা রঙঅ বনঅ ফুল/ জানি লিহঅ গো ধনি পহচলঅ সারুল’  

এ যেন চারিদিকের টিলা পাহাড়ের উন্মুক্ত সবুজ ঢেউ-এ, আকাশের নীলিমায় এক টুকরো জীবন আর যৌবনকে হারিয়ে খোঁজা। মোরাম বিছানো গ্রামের মাটির বাড়ীর আর ছোট ছোট সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, অদ্ভুত মাদকতায় ভরা গোটা প্রকৃতি সন্তান সম গ্রামগুলোকে ঘিরে রাখে।  অনুর্বর মাটিতে কোথাও বা আল বেঁধে জল দিয়ে চাষাবাদের চেষ্টা করছে কৃষিজীবী আদিবাসী কুড়মি সহ হিতমিতানরা ।  ছোট ছোট মাটির দেওয়াল আর খড়-পাতার ছাউনি দেখে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু কোথাও কোন মালিন্য নেই।  সরল গ্রাম্য জীবনে ওরা মাদল বাজিয়ে নাচে, গান করে মেতে ওঠে আনন্দে।   শাল, সেগুনের ভীড়ে  প্রকৃতি সজীব ও সুন্দর । সেই মাতৃসম প্রকৃতির আরাধনা হয় সারুল পরবে।  এখানে সারা বছর ধরেই চলে ঋতু-উৎসবের সমারোহ। প্রকৃতি যখন নতুন সাজে সেজে ওঠে শাল পলাশের রঙে ও গন্ধে তখন প্রকৃতির পূজারী আদিবাসীদের মধ্যেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় সারহুল পরবের মাধ্যমে। 

কুড়মি দিনক্ষেন হিসাবে ১ মাঘকে নতুন শস্য বর্ষ সূচনার প্রথম দিন হিসাবে পালন করে। সেদিন থেকেই জমিতে লাঙ্গল দিয়ে কৃষি কার্যের সূচনা করা তারা। আর দোল পূর্ণিমার পর চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিটি কুড়মি গ্রামে সারুল পরব পালিত হয়।

সুচনা পর্ব=>

কৃষি কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষ যখন প্রকৃতি নির্ভর ছিল তখন শীতের শেষে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ায় নতুন পাতা ও ফুলে গাছগুলো যখন ভরে ওঠে তখনই নতুন প্রকৃতিকে বরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি অধিক ফলমূল দিয়ে মানব জীবনকে নিরাপত্তা দেবে এই কামনাতেই সারহুল পরবের সূচনা। এবার প্রচলিত শ্রুতি অনুসারে -----

সৃৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ  ও প্রকৃৃতি একে অপরের পরিপূরক ,সভ্যতার আদিযুগ থেকেই মানুষ প্রকৃৃতির উপাসক ! 

আদিমযুগে মানুষ সামাজিক ধর্মকর্ম ভূলে ব্যাভিচারে লিপ্ত হলে সৃৃষ্টিকর্তা বিরূপ হন ৷জীবনের রসাস্বাদন করতে গিয়ে অবাধ যৌনাচারে মেতে ওঠে !তাদের কু-কর্মের কথা আদি হড় বুঢ়াবাপের কানে পৌছালে তিনি রেগে যান এবং পৃৃথিবী জুড়ে প্রাকৃৃতিক দুর্যোগের সৃৃষ্টি করেন ৷ ফলস্বরুপ মানব কুল বিপন্ন হয় ৷জীব কুল ও মানবকুল প্রমাদ গোনেন জলোচ্ছাসে ভাসতে ভাসতে হিমালয় পর্বতে আঁঁটকে যায়,এবং তাঁঁরা পর্বত শ্রেষ্ঠ হিমালয়ের কাছে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করেন !হিমালয় রাজ দেবাদিদেব মহেশ্বর অর্থ্যাৎ বুঢ়বাবার কাছে মিনতি করেন ৷মানব কুলের ক্রন্দন মহামায়ের কানে  করে ৷ তিনি  মর্ত্যবাসীদের দু হাত দিয়ে টেনে তুললেন ও তাঁঁদের বরাভয় দেন !৷একসময় দুর্যোগ কেটে যায় ৷প্রকৃৃতি শান্ত হয় ৷ ৷প্রকৃৃতির কোল জুড়ে দেখা দেয়  বসন্তের বাহার ৷রংএ রূপে সেজে উঠল অরন্য —নদী—পর্বত ৷মানুষ বুঝতে পারলো প্রকৃৃতি বিরূপ হলে ধ্বংংস অনিবার্য ৷

প্রকৃৃতির যাবতীয় রূপ রস রংএ প্রকৃতিরই অধিকার। প্রকৃৃতির এই অপার দানকে আদিবাসী সমাজ নতমস্তকে বরন করে নিল ৷এই ঐশ্বর্যের কাছে নতজানু হলো হৃৃদয় ৷প্রকৃতির আশীর্বাদকে পূন্য চিত্তে ,পবিত্র দেহে উৎসর্গের মধ্য দিয়ে গ্রহন করতে হয় ৷শাল মহুয়ার পলাশের ফুল দিয়ে প্রকৃতি, আদিপিতা বুঢ়াবাপ ও মহামায় গরাম বুঢ়ির  অর্চনা করা হয় ৷ফাল্গুনের  পূর্নিমার তিথিতে শাখায় শাখায় শাল পিয়ালের হাতছানি !,মহুয়ার নেশা আর পলাশের রং এ রাঙিয়ে নেওয়ার আগে উপাস্যদের  আশীর্বাদ চাই ৷ সব উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই আনন্দের উদযাপন ।  সারুল পরব ও প্রকৃৃতির কাছে জগতের কল্যানকামনা করেন ,জগতের ,মঙ্গল কামনায় আদিপিতা বুঢ়াবাবার কাছে নতজানু হয়ে দুঃখদুর্দশা থেকে পরিত্রান খোঁঁজেন আর  মহামায়ের কাছে শিশুর মতো আশ্রয় প্রার্থনা করেন !আরাধ্যদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে শাল মহুয়ার প্রসাদী ফুলকে খোঁঁপায় গুঁঁজে বসন্তের  সোহাগী বাতাসে মাতাল হয়ে ওঠে ৷


পূজা পদ্ধতি =>

প্রথম দিন স্নান বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিন। ঘর দুয়ার সহ গরাম থান বা জাহের থান পরিষ্কার করা হয়। গোবর দিয়ে নিকানো পূজাস্থল তৈরি হয়। সন্ধ্যায় লায়া বা দেহরির আদেশ অনুসারে কোথাও কোথাও নাচ লাগে ।  প্রতিটি পরিবারেই মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়।

দ্বিতীয় দিন হয় পুজা বা মূল উৎসবের দিন। লায়া বা দেহরি কে পূজাস্থলে নিয়ে আসা হয়। দেহরি  পূজার সামগ্রী নতুন কুলার আতপ চাল, শাল ফুল, মহুয়া ফুল প্রভৃতি নিয়ে প্রস্তুত হলে গ্রামের যুবক-যুবতীগণ নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসে।

শাল ও মহুয়া ফুল এবং নতুন ফুল দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। পূজা সমাপ্ত হলে নাচগান শুরু হয় এবং নাচতে নাচতে আবার লায়া বা দেহরিকে বাড়িতে পৌঁছায়ে দেওয়া হয়। ফিরে যাওয়ার পথে প্রতিটি বাড়িতে লায়া প্রবেশ করেন  দরজায় বাড়ির মেয়েরা লায়া বা দেহরির পা ধুইয়ে দেন়। পুরোহিত তার ডাল থেকে প্রতিটি বাড়িতে পূজার নতুন শাল ফুল দেন। বাড়িতে মেয়েরা সেই ফুল বণ্টন করে খোপায় গুঁজে নেয় । এবং সারা রাত্রি ব্যাপি চলে আনন্দ উৎসব নাচ গান।  ছৌ-ঝুমুরের মূর্ছনায় আকাশ বাতাস, পাহাড়-নদী-অরন্য কুড়মিদের সাথে আনন্দে মেতে ওঠে। 

সারুল পরব ও  আদিবাসী কুড়মিদের ভূমি, জীবন ও পরিবেশের সম্পর্ক=>

আদিবাসী কুড়মিদের সব উৎসবের সঙ্গেই ভূমি, পরিবেশ, প্রকৃতির ঋতুচক্র, ফসল উৎপাদনের খুবই নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে কুড়মিসহ আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎসব থেকে প্রকৃতির কোন সম্পদ কখন ব্যবহার করতে হবে, সেটি ব্যবহারের এক ধরনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। ভূমিকে কিভাবে ব্যবহার করলে তার উর্বরতা ঠিক থাকবে সেটিও জানা যায়। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে সময়সূচিভিত্তিক সম্পদ ব্যবহারের এক দিক নির্দেশনা থাকে। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করার সময় পায়।

  ফাল্গুন মাসে যখন প্রকৃতিতে নতুন নতুন ফুল ফল পাতা আসে, সেই সময়কে আদিবাসী মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে।  তাই কুড়মালী রীতি অনুযায়ী ফাগুনকে বিহামাস বলে।  প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে নতুন জীবনী শক্তি সঞ্চারের বিষয়টিই বোঝানো হয়। নারীরা বয়ঃসন্ধিকাল পার করে নতুন জীবনী শক্তি সৃষ্টির অধিকারী হয়, তেমনি ফাল্গুন মাসে পৃথিবীও নারীদের মতো বয়ঃসন্ধিকালীন সময় পার করে। নতুনভাবে প্রকৃতিতে জীবনী সঞ্চার করে। অপরদিকে একে প্রেমের মাসও বলা হয়।  কারন আদিবাসী কুড়মিদের বিহা মাস অর্থাৎ  ফাল্গুন মাসে বিয়ে হয় দেখাশুনা  করে নেগাচার মেনে।  তাই কৃষিকার্যে  সাময়িক বিরতি থাকায় বিবাহিত নবদম্পতি একে অপরকে ভালো ভাবে জানার সময় পায়। 

কিন্তু আজকের এ আধুনিক পৃথিবীতে আমরা শুধু ভোগ-বিলাসিতার জীবনযাপনের জন্য পৃথিবীর সম্পদ কোনো হিসাব ছাড়াই আহরণ ও ব্যবহার করছি। আমাদের পৃথিবীকে তার সম্পদের ঘাটতি পূরণেরও সময় দিচ্ছিনা। এভাবেই হয়তো আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী একদিন তার যৌবন হারাবে, বন্ধ হবে তার ঋতুচক্র, শেষ হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সম্পদ। অর্থাৎ ধ্বংস হবে পৃথিবী, ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা।

 সারুল পরবের  মধ্যে আদিবাসী ভূমি, জীবন, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার বিশাল দর্শন লুকায়িত থাকলেও তা আজ নানা কারণে অবহেলিত। তাই সারুল পরবের পুরোনো জৌলুসকে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরী। এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী ভূমি, প্রাণ ও প্রকৃতিকে নতুন করে বাঁচানো সম্ভব হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

জয় গরাম
জহার

Tuesday, March 20, 2018

টুসু'র আসল ইতিহাস





কথিত আছে টুসু একমাস বাপের ঘরে আর এগারো মাস শ্বশুর ঘরে থাকে।
কৃষক কুড়মির শুধু পৌষমাসে ধান খামারে থাকে। আর মাঘের পয়লা দিনেই হালচার করে জমির ইশান কোনে স্থাপন করা হয় ধান বীজ, আষাঢ়ে "পাঁচগাছি" করা হয় জমির উত্তর-পূর্ব তথা 'ইশান' কোনে৷
সেই পাঁচগাছি ধান "ডিনি আনা" হয় সমস্ত পাকা ধান কেটে আনার পর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি বা ছোটো মকরে৷
সেই ডিনি'র ধান নিয়ে স্থাপিত হয় "টুসু"৷ টুসু এত বড় একটা পরব বা পর্ব৷
টুসু পরব কুড়মিদের গুরুত্বপূর্ন একটি বড় পরব..কারন কুড়মিরা হচ্ছে কৃষিজীবী আর সেই কারনে কুড়মিদের সকল পরব হচ্ছে কৃষিভিত্তিক..আর টুসু পরব যে কৃষিভিত্তিক তা আমরা সহজেই বুঝতে পারছি কেননা 1)টুসু পাতা(স্থাপনা) হয় অগ্রহায়ন মাসের(কুড়মালিতে মাইসর মাস)শেষে খেতের সমস্ত ধান খামারে আনার পর..

2)ঘরের দিরখাতে মাটির সরাতে মেয়েরা কিছু ধান রেখে টুসু পাতে আর সারা পৌষ মাস চলে টুসুর আরাধনা..
3)ধান মাড়াই এর কাজ শেষ হওয়ার পর পৌষ মাসের শেষে সেই সরার ধানকে(আরাধ্য টুসু) চৌড়লে চাপিয়ে নদীর জলে বিসর্জন করা হয়..
তাহলে দেখা যাচ্ছে টুসু এখানে ধানকেই বলা হচ্ছে..টুসু কখনও মাটির পুতুল নয় বা কাগজের পুতুল হিসাবে দেখা উচিত নয়..
কারন কুড়মিদের কোনো দেব-দেবীর মাটির মূর্তি নেই..আর এই টুসুর আরাধনা বা স্থাপনার জন্য কোন মন্দিরের দরকার হয় না..চাষীর ক্ষেত থেকে খামার আর খামার থেকে ঘরেই টুসুর বাস..তাই তো টুসু এই কৃষিজীবী কুড়মিদের কখনও মা আর কখনও মেয়ে..কিন্তু ধানকেই যদি এই কুড়মি কৃষিজীবিরা টুসু হিসাবে আরাধনা করে তাহলে তাঁকে জলে বিসর্জন কেন ?কেননা ধানের বংশবৃদ্ধি হয় তখনি যখন জলের স্পর্শে আসে,তাই তো টুসুকে জলে বিসর্জন দেয়..
আমরাকে ভাবতে হবে সেই ধান চাষের আবিষ্কারের সমকালীন সময়ের ঘটনা যখন সেই কৃষিজীবী মানুষের কথা যারা প্রকৃতির কাছ থেকে ধানের বীজ আরোহন করে কৃষি করত..কিন্তু তখন তাঁরা জানত না ধানবীজ সংরক্ষনের..তাই তাঁরা প্রকৃতির কাছ থেকেই ধানবীজ আরোহন করে কৃষি করত...আর এই কারনেই তাঁরা পরিপুষ্ট ধানের মধ্যে কিছু ধান সেই প্রকৃতিকেই ফেরত দিত..সকলেই আনুষ্ঠানিক ভাবে জলে বিসর্জন দিত এই আশাই তাঁরা যেন পরবর্তী বছরেও চাষের জন্য বীজধান পায়..
টুসু "তুষ"শব্দ থেকে কখনও আসে নি কারন তুষ শব্দটি কুড়মালি শব্দ নয়...তুষকে কুড়মালিতে বলে ভুসা..কুড়মালিতে "টুসটুইসা" শব্দটি থেকে টুসু শব্দ আসাটাই স্বাভাবিক,কারন "টুসটুইসা" শব্দের বাংলা অর্থ হলো পরিপূর্ণ..কুড়মালিতে­ টুসু শব্দের সাথে সম্মন্ধযুক্ত আর একটি শব্দ হলো ঠুসল..এই ঠুসল শব্দের অর্থ হলো পরিপূর্ণ..তাই টুসু শব্দের অর্থ হচ্ছে "পরিপূর্ণ ধান", যা বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম..পরিশেষে বলা যায় টুসু হচ্ছে এমন এক শক্তি যে শক্তির দ্বারা কৃষিজীবি সহ সমগ্র মানবজাতির শক্তির সঞ্চার হয়..
তাই এই টুসুর পূজা তথা বিসর্জন করে যারা তাঁরাই কৃষির আবিষ্কর্তা-কুড়মি কৃষিজীবি..
জহার
তথ্য সূত্র:-ওয়েস্ট বেঙ্গল কুড়মালি একডেমি
লিখা:-বিপ্লব মাহাত ও ভূপেন মাহাত.



Sunday, March 18, 2018

স্বাধিনতা সংগ্রামি রঘুনাথ মাহাত।

" আপনা গাঁও,আপনা রাজ,
ধূর খেদা ব্রিটিশ রাজ।"
চূয়াড় বিদ্রোহের মহানায়ক তথা ভারতের প্রথম স্বাধিনতা সংগ্রামি রঘুনাথ মাহাত।
পিতা- কাশিনাথ মাহাত,
মাতা- করমি মাহাত,
জন্ম:- ২১ মার্চ ১৭৩৮,
শহিদ :-৫ এপ্রিল ১৭৭৮,
গ্রাম- ঘঁটিয়াডি,সরাইকেল্লা,ঝাড়খণ্ড।
পিতা কাশিনাথ মাহাত পরগনইত(১২ মৌজার জমিদার) ছিলেন।প্রতিবাদি চরিত্র রঘুনাথ মাহাত কৌশর বয়স থেকেই জল জমি জংগলের জন্য সংগ্রাম করেছেন।একবার পিতা কাশিনাথ মাহাতর সাথে এক তহশিলদারের ঝগড়া হলে তাকে গ্রাম ছাড়া করেন।তার সাহসিকতার খবর ছড়িয়ে পড়ে।জংগলের নানা সমস্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে ধীরে ধীরে লড়াকু নেতা হয়ে উঠে।অতঃপর, ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের চাপিয়ে দেওয়া রাজস্ব ও জল- জমিন- জংগলের অধিকারের দাবীতে মানুষকে সংঘটিত করতে থাকে।১৭৬৯ সালে নিমডি ময়দানে বিশাল সমাবেশের ডাক দেন।তীর ধনুক টাঙ্গি হাতে জমায়েত হয় কয়েক হাজার আদিবাসী।
এদিকে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে মেদিনীপুর ঝালদা পটমদা তমাড় রামগড় সহ সমগ্র ছোটনাগপুরের আদিবাসীরা।ব্রিটিশ সরকার দমনপিড়ন নিতি নিতে বাধ্য হয়।
রামগড় পুলিশ ছাওনি হামলার সিদ্ধান্ত নিতে সিলির নিকট লোটার জংগলে এক গুপ্ত মিটিং এর ডাক দেন।এই মিটিং এর খবর গুপ্তচর মাধ্যম জানতে পারলে ব্রিটিশ পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।সরাসরি সংঘর্ষে শহিদ হন রঘুনাথ মাহাত,বুলি মাহাতানি সহ ১২ জন সংগ্রামী।
মহান জননেতা ও বীর শহিদের অমরআত্মাকে শ্রদ্ধা জানাই।

লেখা ~ সংগৃহীত

Saturday, March 17, 2018

করম পরব


~~করম পরব ~~~

করম পরব ( উত্সব ) আদিবাসী জাতির একটি কৃষি ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী উত্সব । আদিবাসী যেমন – ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, কুড়মি, ভূমিজ সহ প্রায় 38 টি জাতির মানুষ করম পরব পালন করে ।
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাত / পাঁচ / তিন দিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন। তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলিকে রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিন পাক ঘোরে। এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট, জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলিকে বুনে দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়, যাকে জাওয়া ডালি বলা হয়। এরপর ডালাতে ও টুপাতে বীজ বোনা হয়। এরপর প্রত্যেকের জাওয়া চিহ্নিত করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। একে জাওয়া পাতা বলা হয়। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা এই কাজ করেন, তাঁদের জাওয়ার মা বলা হয়। ডালার জাওয়াগুলিকে নিয়ে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন।
করম পুজোর দিন গ্রামের বয়স্কদের একটি নির্দিষ্ট করা স্থানে দুইটি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়, যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর এবং ধরম ঠাকুর হিসেবে পূজিত হন। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যার পরে থালায় ফুল, ফল সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে এই স্থানে গিয়ে পূজা করেন। করম ডালে ভেঁট (আলিঙ্গন) নেন, যা বৃক্ষের প্রতি ভালবাসার প্রতীক । এরপর করম ডাল ও জাওয়া ডালি কে ঘিরে নাচ গান চলে। পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলাশয়ে ।
জোহার করম রাজা. ….



করম পরবের কহনি




করম পরবের কহনি



করম পূজা উপলক্ষে একটা গল্প বলা হয়,  যারা করম করেছে  তারা সবাই এটা শুনে থাকবে,  সেই গল্প টা আজ আমরা দিচ্ছি।।  গল্প বলার সময় সব শ্রোতা কে মাঝে মাঝে “হুঁ ” বলতে হয় জানতো না হলে গল্প বন্ধ হয়ে যেত,,  তো আমি ” হুঁ ” দিতে বলছি না গল্প টা পড়ার পর লাইক ও কেমন লাগছে সেটা জানিয়ে কমেন্ট দিতে অনুরোধ করছি,,
                হামার করম ভাইয়ের ধরম
সে অনেককাল আগের কথা,  করমু আর ধরমু নামে দুই ভাই ছিল।  চাষবাস করে তারা সুখে সাচ্ছন্দেই থাকত,  ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর দিনে তারা করম ঠাকুরের পূজা করত,।  কিন্তু একবার করমু করম ঠাকুরের পূজা করে বাসি ভাত,  বাসি তরকারীর বদলে গরম ভাত আর গরম তরকারী দিয়ে পারন করল।  তার ফলে করম ঠাকুরের গায়ে জ্বালা শুরু হলো।  আর তার কোপে করমুর সংসারে দুঃখ দুর্দশা নেমে এলো।
করমুর সংসারে অভাব অনটন শুরু হলো ,  লোকের ঘর মুনিষ খটতে যেতে শুরু করলো কিন্তু তবু তাদের পেট ভরে খাবার জোটে না,  একদিন করমু আর তার বউ ভাই ধরমু এর চাষের কাজে গেল।  দুপুরে ধরমু সবাইকে খেতে দিল কিন্তু করমু আর তার বউ এর কাছ যখন এল তখন আর খাবার এ কুলাল না।  করমু ভাবল পরে হয়তো তার ভাই খাবার নিয়ে আসবে কিন্তু সন্ধে হয়ে গেল কেউ খাবার নিয়ে এল না, ।  এতে রেগে গিয়ে করমু তার বউ কে বললে চল আমারা যতটা ধান লাগিয়েছি সব নষ্ট করে দেব,। এই বলে তারা দুজনে যেই না ক্ষেতে পা বাড়িয়েছে অমনি হঠাত শুনতে পেল কে যেন বলছে খবরদার আর এক পাও বাড়াবি না,  তুই গরম ভাতে পারন করেছিলি বলে তোর এই দশা,  করম ঠাকুর তোর উপরে রেগে গেছেন,  তোর কপাল বাম হয়েছে তুই সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে করম ঠাকুরের কাছে যা তবেই তোর এই দুর্দশার মুক্তি ঘটবে। তা শুনে সে ত্র বউ কে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে,  সেখান থেকেই রওনা দিল,,  সে সারা রাত হাঁটার পর একটা জায়গা তে পৌছাল,  আগের দিন পেটে কোন খাবার জোটেনি তারউপর এত পরিশ্রম তার প্রচন্ড তিষ্টা আর খিদা লেগেছে,  তখন একটা পুকুরের কাছে এসে থামল,  পুকুর থেকে আজলা করে জল তুলে যেই না খেতে যাবে অমনি সে দেখে জলে অনেক পোকা কিলবিল করছে,  তখন সে ফেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করবে তখন পুকুরটি ডেকে বলল ভাই কোথায় যাচ্ছ?  করমু বলল ” আমার করম কপাল বাম হয়েছে তাই করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি  ।  ” পুকুরটি বলল ” ভাই করম ঠাকুরকে আমার আদ্দাশ জানিয়ে জেনে আসো আমার জলে কেন এত পোকা?  ” করমু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলতে শুরু করলো।  কিছুদুর গিয়ে করমু দেখল একটা বড় ডুমুর গাছে অনেক ডুমুর ধরে আছে,  তখন সে ডুমুর তুলে খাঁড়া করে দেখে অসংখ পোকা, ডুমুরের ভিতরে পোকা দেখে মনের দুঃখে আবার হাঁটতে যাবে তখন ডুমুর গাছ ডেকে বলল ভাই কোথায় যাচ্ছ?  করমু বলল আমার করম কপাল বাম হয়েছে আমি করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি ” তখন ডুমুর গাছ বলল তুমি যাচ্ছ যখন তখন করম ঠাকুর কে আমার আদ্দাশ জানিয়ে আমার ফলে এত পোকা কেন জেনে আসবে।।  করমু হাঁটতে থাকে,  পথের যেন শেষ নেই,  খিদা, তেষ্টা তে দেহ অবসন্ন,  এমন সময় একটা কুঁড়ে দেখতে পেল,  তখন ভাবল যাক এখানে একটু তামাক খেয়ে নিয়ে আবার হাঁটব,  তা সে দরজার কাছে গিয়ে ডাকতে লাগল ” কেউ আছো আমাকে একটু আগুন দেবে??  ভেতর থেকে এক বুড়ি বলল ” বাবা আমার উঠবার উপায় নেই আর আমি দিতেও পারব না, ” করমু উঁকি দিয়ে দেখে আশ্চর্য ব্যাপার বুড়ি একটা কুলা নিয়ে চিংড়িমাছ বেছে চলেছে আর তার পা দুটো উনানে ঢোকান আছে,  উনানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে কিন্তু বুড়ির পা পুড়ছে না।।

তো বুড়ির এরকম অবস্থা দেখে করমু হতাশ হয়ে চলে যেতে উদ্দত হল  ,  তখন বুড়ি তাকে জিজ্ঞাসা করল ” কোথায় যাচ্ছ ভাই?  ” করমু বলল আমি করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি। ” বুড়ি বলল বাবা তুমি যাচ্ছ যখন তখন করম ঠাকুরক্র জিজ্ঞাসা করবে,  আমি উনুনে পা ঢুকিয়ে বসে আছি কিন্তু আমার পাও পুড়ছে না আর চিংড়িমাছ বাছাও শেষ হচ্ছে না কেন?  আবার হাঁটতে শুরু করল করমু,  কতক্ষন যে হাটল তা আর তার দিশা নেই,  হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল এক প্রকান্ড মাঠের সামনে এসে পড়েছে,  আর সেখানে একপাল গরু চরে বেড়াচ্ছে,  করমু ভাবল গরুর দুধ খেয়েই সে পেট ভরাবে,  এই ভেবে যেই না সে একটা গাভী এর কাছে গেল গাভী টা ছুটে পালাল,  আর অন্য গুলো একই কেউ তো আবার শিং উচিয়ে ছুটে এল তখন সে ভাবল যার কপাল বাম হয় তার হয়ত এরকমি অবস্থা হয়,  সে তখন আবার পথ চলা শুরু করল তখন একটা গাভী এসে জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাচ্ছ ভাই?  করমু বললে করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি তখন গাভী বলল করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছ যখন তখন জিজ্ঞাসা করে আসবে আমাদের কোন বাগাল নেই কেন??  করমু ঠিক আছে বলে আবার চলতে শুরু করল,  হাঁটতে হাঁটতে সে একটা জায়গায় এসে দেখল অনেক গুলো ঘোড়া চরছে,  সে তখন চুপিসারে একটা ঘোড়া র পিঠে চাপতে গেল তখন ঘোড়া লাথি মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে পালাল,,   করমু অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল তখন প্রধান ঘোড়া তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাচ্ছ ভাই,  করমু বলল করম ঠাকুরের কাছে যাচ্ছি ,  ঘোড়া বলল তা যাচ্ছ যখন করম ঠাকুরের কাছে জেনে আসবে আমাদের ক্যিন মআলিক নেই কেন আর আমরা কাউকে পিঠে সওয়ার ও নিতে পারিনা কেন??

এরপর করমু আর থামেনি হেটেই চলেছে,  এতক্ষন সে বুঝতে পেরেছে করম ঠাকুরের কাছে পৌছানোর আগে তার খাওয়া জুটবে না, আর এই পা দুটি ছাড়া পৃথিবী র কোন কিছুর সে সাহায্য পাবে না,  তাই সে প্রায় ছুটতে ছুটতেই এগিয়ে যেতে থাকে হঠাত তাকে থেমে যেতে হয়,  সামনে আর পথ নেই শুধু জল আর জল অথৈ সমুদ্র,  কি করবে ভেবে পেল না করমু,  অথচ সমুদ্র না পেরালে সে করম ঠাকুরের কাছে যেতে পারবে না আর করম ঠাকুরের কাছে না গেলেও না খেয়ে মরতে হবে,  যা হবে হবে বাড়ি গিয়ে না খেয়ে মরার থেকে এখানে মরাই ভাল এই ভেবে সে সেখানে বসে পড়ল,  অনেক কিছু তার মনে পড়তে থাকল  তার বউ এর কথাও মনে,  সে একা বাড়িতে না খেতে পেয়ে কি করছে কে জানে,,  দুঃখে তার কাঁদনা চলে এল।  হঠাত দেখল সমূদ্রের জলে কি যেন। একটা ভাসতে  ভাসতে  তার দিকে আসছে,  করমু ভআল করে ঠাওর করে দেখে একটা প্রকান্ড কুমির,  সে ভাবল না খেয়ে মরার থেকে কুমির এর পপেটে যাওয়াই  ভাল ,  এই ভেবে সে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করল ভাবল শেষ বারের মত একটু জোরেই কেঁদে নিই,  তখন কুমির এসে জিজ্ঞাসা করল ভাই কাঁদছো কেন তখন করমু তাকে তার সব দুঃখের কাহানী বলল।  কুমির বলল চিন্তা করোনা ভাই আমি তোমাকে পের করে দেব।  তবে যাচ্ছ যখন জেনে আসবে আমি জলে ডুব দিতে পারি না কেন সব সময় ভেসে থাকতে হয় কেন?  করমু ভাবল কুমির তাকে খেলে খাবে সাহস করে কুমিরের পিঠে চেপে বসিল।।  কুমির তাকে পিঠে বসিয়ে সাঁ সাঁ করে সমুদ্রের জল কেটে এগিয়ে চলল,  এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন তীরে এসে পৌছাল তারা,  করমু নেমেই ছুটতে আরম্ভ করল,  কুমির চিতকার করে বলল ভাই আমার ব্যাপারটাও জেনে আস আর তাড়াতাড়ি আসবে আমি এখানেই তোমার অপেক্ষা করব,,  করমু ছুটতে ছুটতে এক স্বচ্ছ ঝরনার কাছে এসে পড়ল,  সেখানে সে দেখন একজন খুব সুদর্শন ব্যাক্তি জলে ডুবছে আর উঠছে,  তার গা থেকে একরকম চোখ ধাঁধান রশ্মি নির্গত হচ্ছে,।  সে বুঝল এটাই করম ঠাকুর,  সে ছুটে গিয়ে জলে ঝাপ দিয়ে  করম ঠাকুরের পা জড়িয়ে ধরল,  করম ঠাকুর বুঝতে পারল এই সেই করমু তবু জিজ্ঞাসা করল কে তুমি আমার পা ধরলে কেন??  করমু বলল আমাকে ক্ষমা করে দিন প্রভু,  আমি সেই করমু আপনার কোপে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে,  আমাকে ক্ষমা করে দিন না হলে আপনার পা আমি ছাড়ব না।।।।
হামার করম ভাইয়ের ধরম
করম ঠাকুর দেখলেন করমু অনেক কষ্ট আর দুর্ভোগ পেয়েছে তাকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক না,  করম ঠাকুর বললেন তুই গরম ভাতে পান্না করে আমার গায়ে জ্বালা ধরিয়েছিস তাই তোর এই অবস্থা,  তবে যা ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশী তে বাড়িতে করম ডাল পুঁতে আমার পূজা করবি,  আর সকালে নিয়ম মতো বাসি ভাতে পারন করবি তাহলেই তোর সব দুঃখ ঘুচবে । করমু এর পর রাস্তার সবার কথা বলল আর বলল প্রভু এদের ও মুক্তি র উপায় বলে দিন,  এরা আমার অপেক্ষা করছে।  করম ঠাকুর একে একে সবার মুক্তি র উপায় বলে দিল।  এর পর করমু করম ঠাকুর কে প্রনাম করে ফের পথ চলা শুরু করল,  সমুদ্র তীরে এসে দেখে কুমির তার অপেক্ষা করছে।  কুমির বলল ভাই আমার মুক্তি র উপায় টা জেনে এসেছ?  করমু বলল আমাকে আগে ওই পারে পৌছে দাও তার পর তোমার মুক্তি র উপায় বলে দিব।  কুমির তাকে ওপারে পৌছে দিল।  করমু তারপর বলল তুমি অনেক মানুষ খেয়েছ তারমধ্যে অনেক মেয়ে মানুষ ও ছিল তাদের যে সমস্ত গয়না গাটি  তোমার পেটে আছে সেগুলি উগরে বের করে যদি গরিব দুঃখী কে দান কর তাহলেই তুমি আবার ডুবতে পারবে।  কুমির বলল আমি আর গরিব দুঃখী কোথায় পাব,  তুমি  সব নিয়ে যাও। এরপর করমু গয়না গাটি নিয়ে চলতে চলতে ঘোড়া র পালের কাছে এল,  শির ঘোড়া এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল ভাই আমাদের মুক্তির উপায় কি তখন করমু বলল তোমাদের পালের একটা ঘোড়া যদি কাউকে দান কর তাহলেই তোমরা মুক্তি পাবে তখন করমু কে একটা ঘোড়া দিয়ে দিল, করমু ঘোড়া র পিঠে চেপে চলতে লাগল বাকি ঘোড়া গুলো বলল আমরা আর কোথায় যাব তুমি আমাদের মালিক আমারা তোমার সাথেই যাব এই বলে সব ঘোড়া তার সাথে যেতে থাকল,  এইভাবে সমস্ত গাভী ও তার হল,  এরপরে সে সেই বুড়ি র কাছে পৌছাল,  বুড়ি বলল বাছা আমার কথা কি জেনে এলি বল।  করমু বলল আপনি উনুনের কাঠে লাথি মেরেছিলে তাই আপনার এই দশা।  আর আপনার উনুনের নিচে অনেক ধন সম্পদ জমা করে রেখছিল আপনার পূর্বপুরুষরা সেই ধন সম্পদ গরিব দুঃখী কে দান করলে আপনি মুক্তি পাবেন,  বুড়ি বলল বাছা আমি আর কোথায় কাকে পাব তুমি সব নিয়ে যাও।  সে সব নিয়ে করমু আবার যেতে থাকল এর পর সে ডুমুর গাছের কাছে পৌছাল,  ডুমুর গাছকে করমু বলল তোমার গোড়াতে ডাকাতে অনেক সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে সে গুলো যদি গরিব দুঃখী কে দান কর তুমি মুক্তি পাবে।  ডুমুর গাছ বলল আমি আর কোথায় কাকে পাব তুমি সব খুঁড়ে নিয়ে যাও।  এভাবে পুকুরের পাড় থেকেও অনেক সোনা দানা মনি মানিক্য পেল সে, তারপর তার সে পুকুরের জল খেল এবং গরু এবং ঘোড়া গুলিকেও পুকুরের জল খায়িয়ে,  ঘরে ফিরে এল। তারপর একাদশী র দিনে ধুম ধাম করে করম ডাল এনে বাড়িতে করম ঠাকুরের পূজা করল আর গরিব দুঃখী কে দান করল , ।।

কোল কুড়মি কড়া, বেদ বিধি ছাড়া৷ ~ মাঝি মাহত ভাই ভাই৷ ~ কুড়মির মাড়, ভুমিজের কাঁড়৷




কোল কুড়মি কড়া, বেদ বিধি ছাড়া৷মাঝি মাহত ভাই ভাই৷
কুড়মির মাড়, ভুমিজের কাঁড়৷

-- --- ইত্যাদি ইত্যাদি সমূহ বহুল প্রচলিত প্রবাদ গুলি আদিবাসী সমাজের "হড় মিতান" জাতি গোষ্ঠীর সাথে বহু প্রাচীন কাল থেকেই একসাথে সুস্থ ভাবে বসবাস করার ইঙ্গিতেই বহন করে চলেছে।
খেরওয়াল বংশা 'ধরম পুঁথি' ও 'জমসিম বিনতি' শ্রুতি কথা অনুসারে, পুরাকালে এক ব্যাক্তির দুই স্ত্রী ছিলেন৷ বড় বৌ এর দুই সন্তান, যথা "কুড়মি" ও "মুন্ডা" এবং ছোট বৌএর পাঁচ সন্তান, যথাঃ সাঁওতাল, মাহলি, দেশওয়ালী, কড়া ও বিরহড৷ এই বিশ্বাস মতেই আজও "হড় মিত্র" গোষ্ঠী "শিখ শিখর নাগপুর, আধাআধি খড়গপুর" তথা সামগ্রিক ছোটনাগপুর মালভূমিতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিয়ে বসবাস করে চলেছে। এ ছিল প্রাচীন কথা....... ইংরেজ শাসন কালেও আদিবাসী জনজাতি একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে, প্রমাণ স্বরূপ বলা যায় ১৭৭৬ র চুয়াড় বিদ্রোহতে শহিদ রঘুনাথ মাহাত
১৮৩২ র ভুমিজ বিদ্রোহতে গঙ্গানারায়ন সিং র সাথে বুলি মাহাত
১৮৪৩ র ভীল বিদ্রোহতে বিশ্বনাথ সর্দার এর সাথে গোপাল মাহাত
১৮৫৫ র সাঁওতাল বিদ্রোহতে সিধু কানু চাঁদ ভইরব এর সাথে চানকু মাহাত র ও ফাঁসি হয়েছিল
সিপাহী বিদ্রোহতে মঙ্গল পান্ডের সাথে সুকদেব মাহাত
১৯১৭ র মালি আন্দোলন এ কংকা মাহাত
ইনারা সবাই জল জঙ্গল জমির জন্য লড়েছিলেন কিন্তু ইতিহাসে কুড়মি নেতাদের গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার আন্দোলনে সব থেকে বেশি কুড়মি রাই বলিদান দিয়েছে কিন্তু অধিকার কিছুই পাইনি। 
ঝাডখন্ড আন্দোলন হয়েছে সমস্ত আদিবাসীদের মিলিত প্রয়েসেই৷
বছর কয়েক আগে, যখন বাম সরকার মাওবাদী খোঁজার নামে সাঁওতাল মহিলা ছিতা মুর্মুর চোখ কানা করেছিল, পাশে দাঁড়িয়েছে ছত্রধর মাহাত, কয়েকদিন আগে যখন শালবনীর পাথরাজুডি গ্রামে ভুমিজদের পূজাস্থল ব্রাহ্মণবাদীরা দখল করলো..... প্রতিবাদে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন কৃষ্ণ কান্ত মাহাত৷ আদিবাসীদের মিলিত আন্দোলনের কারণে তৎকালীন ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়েছিল "ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন" (1908) লাগু করতে......... অনুরূপেই অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী'র সাথে সাথে কুড়মি'রাও ভারতবর্ষের প্রথম জনগননা 1872 সাল থেকেই আদিবাসী তথা এস.টি. হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে।
স্বাধীন ভারতের এস.টি. তালিকা তৈরী হয়েছে 1913 সালের সেনসাস রিপোর্ট অনুসারে যেখানেও কুড়মি সহ মোট তেরটি জাতি এস.টি. হিসাবে উল্লিখিত রয়েছে৷
স্বাধীন ভারতের কুড়মি জাতি আদিবাসী তালিকায় নেই। স্বাধীকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে চলেছে। এতেই কিছু লোক উসকানি দিচ্ছেন "হড় মিতান" আদিবাসীদের কুড়মি যেন আদিবাসী স্বীকৃতি না পায় তার বিরোধিতা করার জন্য৷ যা সামগ্রিক আদিবাসীদের হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, স্বাধীন ভারতে কনো জাতির উপর কালচারেল রিসার্চ ইনভেস্টিগেশন করে এস.টি. লিষ্ট তৈরি হয়নি, কোর্ট কাছারি হলে 1913 সালের নোটিশটিই বাদ হতে পারে। আরও লক্ষণীয় যে তৎকালীন তেরটি থেকে বর্তমানে 40টি জাতি এস.টি.র সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। নতুন জাতি ঐ তালিকায় আসার সময় কেউ বিরোধিতা করেন নাই, তবে কুড়মির বেলা এত জ্বালা কেন??
১-মধ্য হিমালয়ের থারু রা নিজেদেরকে"ঠাকুর"বলে ঘোষনা করে,পইতা ধারন ও বিবাহের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদেরকে ঠাকুর হিসাবে গ্রহন যোগ্য করে তুলেছে। ★তাও তারা এস টি ★ ২-খাসা উপজাতি নিজেদের কে রাজপুত ঘোষনা করে। ★তাও তারা এস টি★ ৩-হিমাচল প্রদেশের লাহুলি, কিন্নর, গাদ্দি উপজাতি ব্যাপক হারে হিন্দু কালচারে প্রভাবান্বিত। ★তাও তারা এসটি★ ৪-ভুমিজ রা তো শুধু ক্ষত্রিয় হিসাবে দাবী করাই নয় "ভুমিজ ক্ষত্রিয় এসোসিয়েশন "পর্যন্ত করে। ★তাও তারা এস টি ★ ৫-মাহলি রা যে উপজাতি সেটা আজ কাউকে না বললে সে জানতেই পারবে না কারন তারা এত টা বেশি করে নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে বসে আছে। ★তাও তারা এসটি ★ ৬-আমাদের মাননীয় ট্রাইবাল মিনিস্টার এর নিজের কমিউনিটি ওঁরাও দের মধ্যে বাহ্মন দিয়ে শিব পার্বতি রপূজোর চল আছে। ★তাও তারা এসটি ★ ৭-পশ্চিম ভারতের ভীল সহ দুবলা, নায়েকস,গ্যামিট অনেক বেশি হিন্দুত্বে রুপান্তরিত এবং তারা ব্রাহ্মনের সেবা গ্রহন করে। ★তাও তারা সবাই এসটি ★ ৮-দ.ভারতের চেঞ্চু কাদার রা কালি, মারুতি, লিঙ্গমায়া র পূজো করে। ★তাও তারা এসটি ★ ৯-ভারত তথা বেঙ্গলের ট্রাইবাল লিস্টে এক নম্বরে আবস্থান কারী অসুর গোসঠী র ৯০% লোক বর্তমানে খ্রিস্টান। ★তাও তারা এসটি ★ ১০-জঙ্গল মহলের গুপ্তমনি, কনক দূর্গা, মন্দিরের পূজারি লোধা উপজাতির তারা বামুনের মত পইতা ব্যাবহার করে। এমনকি শোনা যায় হিন্দুদের অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা জগন্নাথেও প্রথমে কোন লোধা রাজার দেবতা ছিল। ★তাও তারা এসটি ★ ১১- দ.ভারতের টোডা উপজাতির অবস্থান এন্থ্রোপলোজিস্টদের কাছেও অত্যন্তঘোরালো কারন তারা ভারতের অন্য সমস্থ ট্রাইবের থেকে একদম আলাদা। এতো গেল এন্থ্রোপলোজির কথা এবার আসি ধর্মীয় ব্যপারে। টোডারা বিশ্বাস করে তারা পান্ডবদের বংশ ধর (তারা এখনো সব ভাই মিলে একজন মহিলাকে বিয়ে করে)কিন্তু বর্তমানে তাদের প্রায় ৭০%খ্রিস্টান। সাঁওতালের একংশ হিন্দু, একাংশ খ্রিষ্টান, একাংশ নিজেদের সারি কেউ আবার সারনা বলেন,★তাও তারা এসটি★ এরকম প্রচুর উদাহরন আছে দিতে বসলে শেষ হবে না। *আমার একটাই প্রশ্ন যত নিয়ম কি কুড়মি দের বেলায়? যেখানে সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে "A tribe may followany religion "তাহলে রিলিজিয়ন এর উপর এত জোর কেন দিচ্ছে?? কুড়মিদের আচার- আচরণ, রহন- সহন,নেগ- নেগাচার,ধর্ম,সং স্কৃতি, ভাষা,সবটাতেই আর্য প্রভাবমুক্ত। নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছে কুড়মিরা দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত আদিম জনজাতি। অথচ আদিবাসী তালিকাভুক্ত করনে এত টালবাহানা কেন?
বন্ধু,
কুড়মির কাজ কুড়মিকে করতে দিন.......
মনে রাখবেন "কুড়মি" আর কুর্মী ক্ষত্রিয় এক নয়৷
সম্প্রীতি বজায় রাখুন।
আদিবাসী ঐক্য জিন্দাবাদ!!!!
সারি-সারনা জিৎকার৷

লেখা-ভুপেন মাহাত

Thursday, March 15, 2018

বাঁদনা পরব এর ইতিকথা

বাঁদনা আদিবাসী টোটেমিক কুড়মি জনজাতির অন্যতম প্রধান উৎসব। এর প্রধান উদ্দেশ্য চাষবাস শেষ হওয়ার পর ও নতুন করে চাষের মরশুম শুরু হওয়ার প্রায় মাঝামাঝি সময়টিতে মূলতঃ কৃষিকাজে ব্যবহৃত বলদ-মহিষকে তাদের আলস্যের ভাব কাটিয়ে তোলা। অন্য উদ্দেশ্যটি আজকের দিনে অপ্রাসঙ্গিক হলেও কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা । ঐতিহ্যবাহী দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটির ভিত্তি হল – কৃষিজীবী কুড়মিরা যখন গবাদি পশুকে বনে জঙ্গলে চরানোর জন্য নিয়ে যেতেন, তখন প্রায়শঃই সেগুলিকে (বিশেষতঃ বাছুরকে) বাঘ ও অন্য হিংস্র বন্যপশুর আক্রমনের মুখে পড়তে হত। “গাইকা পুতা ভালা সিসু বালক গউ, মহিসেক পুতা ডামাল ; (অরে)বাঘেক পুতা ভালা দমে বলিমান গউ, রগদাঁই ধরএ ধেনু গাই” –এই প্রাচীন সহরই (বাঁদনা) গীতটি তারই প্রমাণ দেয়। দীর্ঘ পর্য্যবেক্ষণের ফলে কুড়মি জনজাতির মানুষেরা উপলব্ধি করেছিলেন, হিংস্র বন্য পশুর আক্রমণ থেকে তাঁদের নিজেদের পক্ষে গবাদি রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই তাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন – গবাদি পশুগুলির মধ্যে বলবান অংশটিকে (ষাঁড় বা বলদ)আত্মরক্ষার কসরৎ শেখানোর জন্য। অতীতে বাঘের বা নেকড়ের চামড়া বলদকে খুঁটিতে বেঁধে তার নাকমুখের সামনে রেখে সেই পশুটির গায়ের গন্ধ বলদটিকে চেনানো ছাড়াও তাকে ইঁড়কাই বন্যপশুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শিং ও দেহশক্তির প্রয়োগের কেরামতি শেখানোর রীতিই বাঁদনার সূত্রপাত করেছিলেন। “ভালা অহিরে – এতদিন জে খাওআলি বঝা বঝা ঘাঁসঅরে অহিরা, আইজঅ তহর দেখিবঅ মদদানি রে”।এই গীতে সেই উদ্দেশ্য প্রকট। বাঘের চামড়ার অভাবে বর্তমানে গরুমোষের চামড়াই (Hide) ব্যবহৃত হয়।
প্রথম উদ্দেশ্য অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানসম্মত । কৃষিজীবী কুড়মি জনজাতির জীবনজীবিকায় বলদ-গাইয়ের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ওগুলি ছাড়া কৃষিকাজ সম্পন্ন করা অসম্ভব ছিল। তাই “গরইআ” বা “গহাইল”পুজার মাধ্যমে গো-ধনকে মাতৃশ্রদ্ধায় পুজা করা হয় ।পুজার কোন মন্ত্র নেই, নিজেরাই পুজারী। মনে মনে যে মন্ত্র বলা হয় তা হল “সুস্হ নিরোগ থাক। দুধ ঘি দাও, গবরসার দাও, হাল টান গাড়ি টান গতর লাগাঁই, হামদিককে বাঁচাঁই রাখ’ । উপাচার – শালুক ফুল আর নৈবেদ্য হল চালের গুঁড়ি জলছাড়া দুধে গুলে বাড়ীতে তৈরী বিশুদ্ধ ঘিয়ে ছেঁকে তৈরী করা পিঠা।
বাঁদনার প্রথমদিনে ভাল করে স্নান করিয়ে শিংএ সরষের তেল মাখানো ও শিং ভর্তি সিঁদুরের তিলক লাগানো, সারা গায়ে নিজের টোটেমের চিহ্ন রং দিয়ে এঁকে দেওয়া, দুই শিং বরাবর ধানের শিসের মোড় (মুকুট) পরানো, গলায় বুনো ফুলের মালা পরানো হয় এবং তারপর সপরিবারে ভক্তিভরে গরু চুমানো ও পুজা করা হয়। সেইদিনের রাত্রিবেলা (অমাবস্যা) সারা রাত গাই গরুকে ঘুমাতে দেওয়া হয় না, জাগিয়ে রাখা হয়। গরু-জাগরনের রাতে ধাঙইড়ারা (গরু জাগানোর দল) বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সহরই গীত গাহে প্রতিটি কৃষকের বাড়ীতে ঢুকে ।সঙ্গে থাকে ঢোল, ধামসা, মাদল্ করতাল, সাহনাই, পেঁপতি, টিনভাঙ্গা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। গহাইলের সামনে যখন গীত গাহা হয় তখন বাদ্য বন্ধ থাকে আর গীতের শেষ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে সকলে “কুলকুলি” (মুখের ওষ্ঠ ও হাতের তালুর সাহায্য একপ্রকার চীৎকারমূলক শব্দ)দিয়ে সব বাদ্য একসাথে “গিজজি গিজিং গিজিগিন, গেজাক গেজাক গিজিগিন”- এই বোলে বাজতে থাকে পুণরায় গীত শুরু না হওয়া অবধি। যথারীতি এই বিকট অথচ ছন্দমধুর আওয়াজে গরুবলদের ঘুমানোর উপায় থাকে না। তাছাড়া সারা রাত গুহাইলে ঘিএর প্রদীপ জ্বেলে আলোকিত রেখে ও মাঝে মাঝেই খড়-ছানি খেতে দিয়েও জাগিয়ে রাখা হয়। পরদিন দুপুরের পর বুঢ়ি বাঁদনা পালনের জন্য গরুখুঁটা ও কাড়াখুঁটা উৎসব-অনুষ্ঠান হয়।
এবার আরো একটু ভেতরে জাই
“সুইনেছি ভাদরের কাঁদনা
আসছে পরব মকর বাঁদনা”
আদিবাসীরা রাই(খামিদ/মালিক),রইয়া (খামিধান/মালকিন) কৃষিকাজে বরদা/বলদের সাহায্যে সম্পন্ন করে বলে সহযোগী বরদাকে ঊৎসাহিত ও সম্মান দেওয়ার জন্য সোহরাই বা বাঁন্দনা পরব পালন করে।
সেই সঙ্গে বরদার মা অর্থাৎ গাইয়েরও পূজা হয়। কারন গাই ছাড়া বরদা কি খরে আসবে? তাই গাইকে কৃতঞ্জতা জানাতে গরইয়া পূজা হয়।
কুড়মালি শাসন ব্যবস্হায় রাই/রইয়ার প্রচলন আদি কাল থেকেই। সে জন্য বরদার বাঁদনা, সহরাই আর গাইয়ের গোরইয়া করে সম্মান জানানো হয়।
বাঁদনার 11 পর্ব।
1.তেলদেওয়া
2.গঠপূজা
3.জাগান
4.জাগান বা ঝাঁগড
5.গহাল পূজা
6.চূমান
7.কাঁচিজিওরি
8.চৈখপূরা
9. নিমছান
10.গরুখুঁটা
11.কাঁটা কাড়হা
প্রতিটা নেগে 11 টা নিয়ম আছে। যেমন বিহাঘর মরাঘর ইত্যাদি তে বিভিন্ন নেগ ব্যবহার হয়।প্রতিটি নেগাচারের পিছনে বৃহৎ অর্থ লুকিয়ে আছে।যা আমরা অনেকেই এই বৃহৎ অর্থকে জানার চেষ্টা করি না,আবার জানলেও গুরুত্ব দিই না।কিন্তু আপনারা মনে করে দেখবেন অহিরা গীত মানে শুধু মাদৈল থাপড়া নয়,এর মধ্যদিয়ে বহু তথ্য তুলে ধরা হয়। সমস্ত ছোটনাগপুরের লক্ষ লক্ষ কুড়মি আদিবাসীর পরব বাঁন্দনা।
 আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি আমাদের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ধর্ম, ইতিহাস, ভাষা এবং সংস্কৃতি বাঁচিয়ে  রাখবোই।
 জহার
সুত্র সহযোগীতা:
অনাদি কুমার মাহাত
  ও কুুুুড়মি সমাজের বরিষ্ঠ নাগরিকগন


আদিবাসী কুড়মি সমাজে বিহাঘর (বিয়ে)

==============================

 ~~মৃন্ময় বঁসরিয়ার ~~

“আম ডালে মহুল ডালে ছামড়া ঘেঁরেছে হামদের ঘরের ছুটু মুনু লগনে বঁসেছে ও মুনু কাঁদিস কেঁনে রে.....?? বাজ বাজনাই বর আইসবেক যাবেক তকে নিঁয়ে”- লোক কবি সুভাষ মাহাত আইখান দিন (পয়লা মাঘ) থেকে আমার অনেক ভাই-দাদা কইনা দেখা শুরু করেছেন। বোন-দিদিরা প্রস্তুতিপর্ব শুরু করে দিয়েছেন। বিয়ের কথা শুনলেই ছেলে-মেয়েদের মনে লাড্ডু ফোটে। ফোটাটাই স্বাভাবিক কারণ বিয়ের মাধ্যমেই মানুষ তার বাকীটা জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী খুঁজে পায়। খুঁজে পায় তার বাকীটা জীবন পথের নির্ভরযোগ্য সফর সঙ্গী। তার উপর আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলা,সুস্বাদু খাওয়া-দাওয়া এবং সাঁজু-গুজু করে প্রচুর ছবি তোলা সব মিলিয়ে বিয়ে আমাদের জন্য আনন্দ উপভোগের অন্যতম একটা মাধ্যম। কিন্তু এই বিয়েই আবার কারো কারো জন্য কষ্টকর,হতাশাগ্রস্ত এবং অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। আর এর প্রধাণ কারণ হলো বিয়ের সব অদ্ভুত নেগাচার (নিয়ম কানুন)। যার জন্য অনেকে নিজের আভিজাত্য ও লোকদেখানোর জন্য পূর্ব পুরুষের নেগাচার ছেড়ে ব্রাহ্মন্যবাদের স্মরনাপন্ন হন। কিন্তু কখন যে আপনারা নিজের পূর্বপূরুষদের অসম্মান করছেন সেটা আপনারা বুঝতেই পারেন না। লোকমুখে শুনেছি “নান্নিমুক শ্রাদ্ধ” যা হিন্দুরা বিয়ের আগে কূল দেবতা ও পুর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে করেন তাদের শান্তি ও পারমিশান নেওয়ার জন্য। এবার বলুন তাদের দেখানো পথ পরিত্যাগ করে, তাদের সৃষ্ট নেগাচার ছেড়ে তাদেরকে অসম্মান করার পর পারমিশান চাইতে লজ্জা করে না কি??? তাঁরা হয়তো আপনাকে আশির্বাদ করবেন কিন্তু আপনি তাঁদের কি দিলেন বিনিময়ে??? কিছুনা উল্টো ব্রাহ্মন দক্ষিনা নিয়ে চম্পট। আদিবাসী কুড়মি সমাজের “সার সাগুনে বিহা” অর্থাৎ ষোলটি বিশেষ নেগাচার দ্বারা সম্পন্ন হয়। বর পক্ষ এবং কইনা পক্ষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । প্রাচীন ভারতের আদিম অধিবাসী কুড়মি সমাজে বিয়ের ধরন দেখে বিভিন্ন প্রকারে বিন্যাস করা হয়েছিল। এর সবকটি ছিল সম্পূর্ণভাবে নেগাচার ভিত্তিক। তাতে কোন প্রকার মন্ত্রোচ্চারণ বা যাগযজ্ঞের প্রয়োজন হতো না। ভারতের ছোটনাগপুর,আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাসকারী কুড়মি জাতি এত ঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করে আজো তাদের নেগাচার মিটাতে পারেনি আর আমরা যদি সচেতন হই আর কোনোদিন পারবেও না । বৈদিক আচারগুলির সঙ্গে নেগাচারগুলির দুর দুর পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই। অতীতে কুড়মি সমাজে বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল।শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যেহেতু বাল্যবিবাহ রোধ করা যায়নি তাই বর্তমানে বাল্যবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ। বর্তমান কালে পরিণত বয়সেই বিবাহ প্রথা প্রচলিত। তবে বিবাহে পণপ্রথা এখনও বহুল প্রচলিত যদিও কুড়মি সমাজে কন্যা পন আছে। কন্যাপক্ষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে তারা পাত্রকে কোন উপহার সামগ্রী দেবে কিনা। আসুন বিয়ের প্রকাভেদ একটু জানি। কুড়মিদের বিয়ে কয় প্রকার ====================

 1. মাড়ুআ বিহা,  2. গলট বিহা, 3. সাঁঘা বিহা, 4. কইরা বিহা, 5. বেঁদকড়ি বিহা, 6. দু-চুল্হা জরি বিহা,7. ঘরজামাইআ বিহা, 8. রাজিখুশি বিহা, 9. পিরীত বিহা, 10. ভেগুড়া বিহা ,11. দুকনি বিহা,12. সিঁদুর ঘসা বিহা, 13. মাথা ভারি বিহা বেহার নেগ ========= 

বরদেখা 2. কইনা দেখা 3.লগন বাঁধা / পহচানা 4.অধিবাস 5.ছামড়া গুড়া/ ছামড়া খাটা 6.মাড়ুআ পূজা 7. বড়ি পাড়া 8. সাজনি সাজা 9.আম্লঅ খাওয়া 10.গুয়া টিকা11.চইখপুরা 12.শালা ধুতি 13.মহুল বিহা 14.সিঁদরা দান(বিহা) 15.ভজ 16.পতরি বদল ( ডুভি বদল)17.চুমান-বাদান18.ঘর ভরা 19.বর বিদাই 20.মুহ দেখানি 21.দুয়ার টেকা 22.ঘটি লুকা 23.গইড় ধুয়া 24.বেহাইন দেখা 25.ছাতা ধরা 26. ঘুরা ফেরা, করম শাঢ়ি প্রভৃতি । 

এবার আসুন শুধু এক্ষেত্রে সাম্যবাদ কতটা তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ছামড়া বাঁধা> গাঁয়ের পুরুষরা। মাড়ুয়া গাড়ে> অবিবাহিত ভাই। মাড়ুয়া পূজা> বর বা কনের পিতা। লগন বাঁধা> দাদু। হলুদ তেল মাখা> গাঁয়ের মহিলারা। সাজনি সাজা> গাঁয়ের পুরুষরা। বাহির ভিতর> বৌদি। আলতা পিঁধা> লাপিত। কাখনা বাঁধা> জামাই দা। আমল খায়> মা মাসীরা। চৈখ পুরায়> পিসি। বাজ বাজনা> ডম। সিনই কুটুম> সাঁওতাল বা অন্য ভ্রাতৃপ্রতিম জাতি। গুয়া টিকা ও ডুভা বদল> কাকা। সিনই বদল ও সিঁদরা দান> বর কনে। শালা ধুতি> শালা। আমলঅ পানি> বোন বা দিদি। চুমান> মায়েরা। লগদিন> মামাদিদি। আগুড় লাগা/ গড় ধূয়া> বহিন/ভাই। গরাম ঠাকুরের দায়িত্বে> লায়া। একটা বিয়েবাড়িতে সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কুড়মিরাই সমাজবদ্ধ জিবন শুরু চরেছিল এর থেকেই প্রমানিত। আসুন গর্ব করে স্বমূর্তি ধারন করি। ব্রাহ্মণ বর্জিত বিয়ে করে আত্মিয় স্বজন সহ পাড়ার সকলকে নিজের আনন্দের শরিক করে সকলের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা নিয়ে নতুন জীবন শুরু করুন। 





কৃতজ্ঞতা স্বীকার “জনজাতি পরিচিতি” - লক্খীকানতঅ মুতরুআর মাহাত অনলি গ্রুপ। আদিবাসী কুড়মি সমাজ যারা এবছর বিয়ে করছেন তাদেরকে আদিবাসী কুড়মী সমাজের পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা। আগামী জীবন সার্থক, সুখের এবং মধুময় হোক। জহার

মরাঘরে নেগাচার ও চড়ক পরব

মরাঘরে নেগাচার ও চড়ক পরব
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বুঢ়াবাপের উড়া ফুরাঞ গেল রে
গঁগাজল, হলৈদ মাখা মাখি
ঢেলকা জাঁকাজাকি - এই বোলটি
পরিষ্কার প্রমান করে যে চড়ক
আসলে আদিপিতার
মৃত্যুবার্ষিকি উদযাপন।
1) চড়ক কথাটির উত্পত্তি
কুড়মালি চড়কা শব্দ থেকে,
মরাঘরে ঘাটুয়াল এবং চড়কের
ভগতাদের শ্রদ্ধার প্রতিক চড়কা
(বাংলা অর্থ সাদা) পোশাক
পরতে দেখা যায়।
2) কেউ মারা গেলে তাঁকে প্রথমে
তুলসী পিঁঢ়ার সামনে এনে গায়ে
তেল হলুদ মাখিয়ে সাদা পোশাখ
পরিয়ে ধূপ ফুল ইত্যাদি দিয়ে
শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত
ব্যাক্তি নেতৃস্থানীয় হলে
বসতিও ঘোরানো হয়। অনুরূপে
গাজনে আদিপিতার নকল মরদেহ
পট তৈরী করে প্রতিটি বাড়ির
তুলসী পিঁড়ার কাছে এনে পূজা
করা হয়।
3) মৃত ব্যাক্তির সন্তানস্থানীয়
ব্যক্তিগন শান্তিক্রিয়ার আগে
পর্যন্ত তেল মাখেনা, মশলা
বিহীন সেদ্ধ খাবার খায়, হতে
রাখে লোহা, আসনে বসেনা। ঠিক
তেমনি চড়কের ভগতারাও ব্রত
পালন করে।
4) ঘাটসিনানের আগের রাতে
ঘাটুয়ালরা এবং ঘাটফড়ের আগের
রাতে ভগতারা হব্বিস করে আহার
করেন।
5) ঘাটস্নানের পর ঘাটুয়ালরা
তুলসী পিঁঢার চারদিকে
আড়াইপাক ঘুরে মৃতব্যাক্তির
শয়নস্থানে জল দেয়। তেমনি
ঘাটফড়ের দিনে স্নান করে এসে
শিবশিলায় জল দেওয়া হয়।
6) মরাঘরে মৃতের শ্মরনার্থে
জাগর জ্বালা হয়, অনুরূপেই
দেখাযায় চড়কেও
মারাত্মক ভুল হয় মরাঘরে
বৈষ্টমকে দিয়ে কির্তন করালে।
কৃতজ্ঞতাঃ চারিয়ান দা