লেখা ~ মৃন্ময় বঁসরিয়ার
লালমাটির মহুল-মাতাল গন্ধে মাতোয়ারা শাল-পিয়াল-সোনাঝুরির সবুজ রাজত্বের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে শিমূল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ায় রং-এর মাতামাতি দেখে মনে হয় বনে বনে আগুন লেগেছে। গানের কলি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠলো —
‘ফুটলঅ সারইও ফুল/ নানা রঙঅ বনঅ ফুল/ জানি লিহঅ গো ধনি পহচলঅ সারুল’
এ যেন চারিদিকের টিলা পাহাড়ের উন্মুক্ত সবুজ ঢেউ-এ, আকাশের নীলিমায় এক টুকরো জীবন আর যৌবনকে হারিয়ে খোঁজা। মোরাম বিছানো গ্রামের মাটির বাড়ীর আর ছোট ছোট সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, অদ্ভুত মাদকতায় ভরা গোটা প্রকৃতি সন্তান সম গ্রামগুলোকে ঘিরে রাখে। অনুর্বর মাটিতে কোথাও বা আল বেঁধে জল দিয়ে চাষাবাদের চেষ্টা করছে কৃষিজীবী আদিবাসী কুড়মি সহ হিতমিতানরা । ছোট ছোট মাটির দেওয়াল আর খড়-পাতার ছাউনি দেখে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু কোথাও কোন মালিন্য নেই। সরল গ্রাম্য জীবনে ওরা মাদল বাজিয়ে নাচে, গান করে মেতে ওঠে আনন্দে। শাল, সেগুনের ভীড়ে প্রকৃতি সজীব ও সুন্দর । সেই মাতৃসম প্রকৃতির আরাধনা হয় সারুল পরবে। এখানে সারা বছর ধরেই চলে ঋতু-উৎসবের সমারোহ। প্রকৃতি যখন নতুন সাজে সেজে ওঠে শাল পলাশের রঙে ও গন্ধে তখন প্রকৃতির পূজারী আদিবাসীদের মধ্যেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় সারহুল পরবের মাধ্যমে।
কুড়মি দিনক্ষেন হিসাবে ১ মাঘকে নতুন শস্য বর্ষ সূচনার প্রথম দিন হিসাবে পালন করে। সেদিন থেকেই জমিতে লাঙ্গল দিয়ে কৃষি কার্যের সূচনা করা তারা। আর দোল পূর্ণিমার পর চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিটি কুড়মি গ্রামে সারুল পরব পালিত হয়।
সুচনা পর্ব=>
কৃষি কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষ যখন প্রকৃতি নির্ভর ছিল তখন শীতের শেষে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ায় নতুন পাতা ও ফুলে গাছগুলো যখন ভরে ওঠে তখনই নতুন প্রকৃতিকে বরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি অধিক ফলমূল দিয়ে মানব জীবনকে নিরাপত্তা দেবে এই কামনাতেই সারহুল পরবের সূচনা। এবার প্রচলিত শ্রুতি অনুসারে -----
সৃৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ ও প্রকৃৃতি একে অপরের পরিপূরক ,সভ্যতার আদিযুগ থেকেই মানুষ প্রকৃৃতির উপাসক !
আদিমযুগে মানুষ সামাজিক ধর্মকর্ম ভূলে ব্যাভিচারে লিপ্ত হলে সৃৃষ্টিকর্তা বিরূপ হন ৷জীবনের রসাস্বাদন করতে গিয়ে অবাধ যৌনাচারে মেতে ওঠে !তাদের কু-কর্মের কথা আদি হড় বুঢ়াবাপের কানে পৌছালে তিনি রেগে যান এবং পৃৃথিবী জুড়ে প্রাকৃৃতিক দুর্যোগের সৃৃষ্টি করেন ৷ ফলস্বরুপ মানব কুল বিপন্ন হয় ৷জীব কুল ও মানবকুল প্রমাদ গোনেন জলোচ্ছাসে ভাসতে ভাসতে হিমালয় পর্বতে আঁঁটকে যায়,এবং তাঁঁরা পর্বত শ্রেষ্ঠ হিমালয়ের কাছে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করেন !হিমালয় রাজ দেবাদিদেব মহেশ্বর অর্থ্যাৎ বুঢ়বাবার কাছে মিনতি করেন ৷মানব কুলের ক্রন্দন মহামায়ের কানে করে ৷ তিনি মর্ত্যবাসীদের দু হাত দিয়ে টেনে তুললেন ও তাঁঁদের বরাভয় দেন !৷একসময় দুর্যোগ কেটে যায় ৷প্রকৃৃতি শান্ত হয় ৷ ৷প্রকৃৃতির কোল জুড়ে দেখা দেয় বসন্তের বাহার ৷রংএ রূপে সেজে উঠল অরন্য —নদী—পর্বত ৷মানুষ বুঝতে পারলো প্রকৃৃতি বিরূপ হলে ধ্বংংস অনিবার্য ৷
প্রকৃৃতির যাবতীয় রূপ রস রংএ প্রকৃতিরই অধিকার। প্রকৃৃতির এই অপার দানকে আদিবাসী সমাজ নতমস্তকে বরন করে নিল ৷এই ঐশ্বর্যের কাছে নতজানু হলো হৃৃদয় ৷প্রকৃতির আশীর্বাদকে পূন্য চিত্তে ,পবিত্র দেহে উৎসর্গের মধ্য দিয়ে গ্রহন করতে হয় ৷শাল মহুয়ার পলাশের ফুল দিয়ে প্রকৃতি, আদিপিতা বুঢ়াবাপ ও মহামায় গরাম বুঢ়ির অর্চনা করা হয় ৷ফাল্গুনের পূর্নিমার তিথিতে শাখায় শাখায় শাল পিয়ালের হাতছানি !,মহুয়ার নেশা আর পলাশের রং এ রাঙিয়ে নেওয়ার আগে উপাস্যদের আশীর্বাদ চাই ৷ সব উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই আনন্দের উদযাপন । সারুল পরব ও প্রকৃৃতির কাছে জগতের কল্যানকামনা করেন ,জগতের ,মঙ্গল কামনায় আদিপিতা বুঢ়াবাবার কাছে নতজানু হয়ে দুঃখদুর্দশা থেকে পরিত্রান খোঁঁজেন আর মহামায়ের কাছে শিশুর মতো আশ্রয় প্রার্থনা করেন !আরাধ্যদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে শাল মহুয়ার প্রসাদী ফুলকে খোঁঁপায় গুঁঁজে বসন্তের সোহাগী বাতাসে মাতাল হয়ে ওঠে ৷
পূজা পদ্ধতি =>
প্রথম দিন স্নান বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিন। ঘর দুয়ার সহ গরাম থান বা জাহের থান পরিষ্কার করা হয়। গোবর দিয়ে নিকানো পূজাস্থল তৈরি হয়। সন্ধ্যায় লায়া বা দেহরির আদেশ অনুসারে কোথাও কোথাও নাচ লাগে । প্রতিটি পরিবারেই মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়।
দ্বিতীয় দিন হয় পুজা বা মূল উৎসবের দিন। লায়া বা দেহরি কে পূজাস্থলে নিয়ে আসা হয়। দেহরি পূজার সামগ্রী নতুন কুলার আতপ চাল, শাল ফুল, মহুয়া ফুল প্রভৃতি নিয়ে প্রস্তুত হলে গ্রামের যুবক-যুবতীগণ নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসে।
শাল ও মহুয়া ফুল এবং নতুন ফুল দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। পূজা সমাপ্ত হলে নাচগান শুরু হয় এবং নাচতে নাচতে আবার লায়া বা দেহরিকে বাড়িতে পৌঁছায়ে দেওয়া হয়। ফিরে যাওয়ার পথে প্রতিটি বাড়িতে লায়া প্রবেশ করেন দরজায় বাড়ির মেয়েরা লায়া বা দেহরির পা ধুইয়ে দেন়। পুরোহিত তার ডাল থেকে প্রতিটি বাড়িতে পূজার নতুন শাল ফুল দেন। বাড়িতে মেয়েরা সেই ফুল বণ্টন করে খোপায় গুঁজে নেয় । এবং সারা রাত্রি ব্যাপি চলে আনন্দ উৎসব নাচ গান। ছৌ-ঝুমুরের মূর্ছনায় আকাশ বাতাস, পাহাড়-নদী-অরন্য কুড়মিদের সাথে আনন্দে মেতে ওঠে।
সারুল পরব ও আদিবাসী কুড়মিদের ভূমি, জীবন ও পরিবেশের সম্পর্ক=>
আদিবাসী কুড়মিদের সব উৎসবের সঙ্গেই ভূমি, পরিবেশ, প্রকৃতির ঋতুচক্র, ফসল উৎপাদনের খুবই নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে কুড়মিসহ আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎসব থেকে প্রকৃতির কোন সম্পদ কখন ব্যবহার করতে হবে, সেটি ব্যবহারের এক ধরনের নির্দেশনা পাওয়া যায়। ভূমিকে কিভাবে ব্যবহার করলে তার উর্বরতা ঠিক থাকবে সেটিও জানা যায়। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে সময়সূচিভিত্তিক সম্পদ ব্যবহারের এক দিক নির্দেশনা থাকে। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করার সময় পায়।
ফাল্গুন মাসে যখন প্রকৃতিতে নতুন নতুন ফুল ফল পাতা আসে, সেই সময়কে আদিবাসী মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে তুলনা করে। তাই কুড়মালী রীতি অনুযায়ী ফাগুনকে বিহামাস বলে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে নতুন জীবনী শক্তি সঞ্চারের বিষয়টিই বোঝানো হয়। নারীরা বয়ঃসন্ধিকাল পার করে নতুন জীবনী শক্তি সৃষ্টির অধিকারী হয়, তেমনি ফাল্গুন মাসে পৃথিবীও নারীদের মতো বয়ঃসন্ধিকালীন সময় পার করে। নতুনভাবে প্রকৃতিতে জীবনী সঞ্চার করে। অপরদিকে একে প্রেমের মাসও বলা হয়। কারন আদিবাসী কুড়মিদের বিহা মাস অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে বিয়ে হয় দেখাশুনা করে নেগাচার মেনে। তাই কৃষিকার্যে সাময়িক বিরতি থাকায় বিবাহিত নবদম্পতি একে অপরকে ভালো ভাবে জানার সময় পায়।
কিন্তু আজকের এ আধুনিক পৃথিবীতে আমরা শুধু ভোগ-বিলাসিতার জীবনযাপনের জন্য পৃথিবীর সম্পদ কোনো হিসাব ছাড়াই আহরণ ও ব্যবহার করছি। আমাদের পৃথিবীকে তার সম্পদের ঘাটতি পূরণেরও সময় দিচ্ছিনা। এভাবেই হয়তো আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী একদিন তার যৌবন হারাবে, বন্ধ হবে তার ঋতুচক্র, শেষ হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সম্পদ। অর্থাৎ ধ্বংস হবে পৃথিবী, ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা।
সারুল পরবের মধ্যে আদিবাসী ভূমি, জীবন, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার বিশাল দর্শন লুকায়িত থাকলেও তা আজ নানা কারণে অবহেলিত। তাই সারুল পরবের পুরোনো জৌলুসকে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরী। এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী ভূমি, প্রাণ ও প্রকৃতিকে নতুন করে বাঁচানো সম্ভব হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
জয় গরাম
জহার
0 comments: